আমার আত্মজীবনী পাঠ- তৃতীয় পর্ব

এক.

মৃত্যুর পর তোমরা আমাকে কংশের জলে ভাসিয়ে দিও।
যদি শিমুলের তুলা হতাম, বাতাসে উড়িয়ে দিতে বলতাম,
কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, আমি বাতাসের চেয়ে হালকা নই।
আমাকে তোমরা কাঠের আগুনে পুড়িয়ে ফেলো না,
কিংবা মাটি খুঁড়ে কবর দিও না আজিমপুর বা বনানীতে।
বর্জ্যপদার্থের মতো আমি চাই না মাটিতে মিশে যেতে।
মৃত্যুর পর তোমরা আমাকে কংশের জলে ভাসিয়ে দিও।
যাতে জলপথে ভাসতে-ভাসতে, ভাসতে-ভাসতে
আমি পৌঁছুতে পারি পৃথিবীর নব-নব দেশে।

না। তাঁর মৃত্যু ঘটেনি। তেমন দূর্ঘটনা যেন না ঘটে। শতায়ু হন কবি, কবি নির্মলেন্দু গুণ। তবে তাঁর বাসনা টিকে বড়োই করুণ আর মনোরম লাগে, তাই কবিতাংশটি উঠিয়ে দেয়া।

নেত্রকোনা জেলার (তৎকালীন মহকুমা) কংসের তীরের কবি নির্মলেন্দু গুণ। তাঁর জীবনী গ্রন্থ-“আমার কণ্ঠস্বর” এবারের গ্রন্থালোচনার বিষয়। আপনারা বলতে পারেন, কতো- কতো জীবনী গ্রন্থইতো রয়েছে। তবে কেনো এটি? আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই প্রথম আলোচনাটির কথা, সেখানে হুমায়ুন আজাদ বাংলা ভাষায় লিখিত আত্মজীবনী গ্রন্থগুলোর ব্যাপারে তাঁর হতাশা ব্যক্ত করে সেগুলোকে মোটামুটি উড়িয়ে দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছিলাম (একটি প্রবন্ধের সূত্র ধরে)। আজকে আমি একজন বাঙালির আত্মজীবনীকেই আলোচনায় নিয়ে এসেছি, সফল অর্থে, (ভবিষ্যতে আরো কয়েকজনের আসবে)। আফসোস, জানা হবে না এই গ্রন্থটি নিয়ে হুমায়ুন আজাদের অনুভূতির কথা।

বইটিতে নির্মলেন্দু গুণের পূর্ণাঙ্গ জীবন কাহিনি নেই। জীবন নামের গাড়িটির গল্প বলতে গিয়ে কবি ১৯৭০ পর্যন্ত গিয়ে থামিয়ে দিয়েছেন গ্রন্থের চাকা, যখন কেবলমাত্র তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ-প্রেমাংশুর রক্ত চাই প্রকাশিত হয়েছে।

নির্মলেন্দু গুণ বাংলা ভাষার একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি। তিনি জাত কবি, এবং কবিতার জন্য জীবনৎসর্গ করার মতো সাহসী কবিদের মধ্যে অন্যতম একজন। ছোটবেলা থেকে ছিলেন দূরন্ত, কিন্তু মেধাবী। মেধার স্বাক্ষর রেখে মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক, তারপর সেই যে ভবঘুরে হলেন, বাকী জীবনটা তাঁর আর থিতু হয়নি।

তাঁর দূরন্তপনা শুরু হয় মূলত ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে উচ্চমাধ্যমিক ক্লাসে ভর্তি হবার পর থেকে। লেখাপড়ার চেয়ে জুয়া খেলার দিকেই তাঁর নজর ছিল বেশি। একবার কলেজের হিন্দু হোস্টেলের ম্যানেজার নির্বাচিত হলেন। শুরু হলো বাজারের টাকা মেরে দেবার কাজ। সেই টাকা দিয়ে বহু শখের টেডি জুতো কেনা হলো, আরো কেনা হলো আকাশী নীল কেরলিন শার্টও। কথা আছে পাপ নাকি বাপকেও ছাড়ে না। জুয়ার আড্ডায় ধরা পড়লেন নির্মলেন্দু গুণ, সঙ্গে সঙ্গে পত্রপাঠ বিদায়। সাঙ্গ হলো তাঁর আনন্দমোহনের আনন্দময় রাত-দিনের আড্ডা। ফিরে এলেন নেত্রকোনায়, ভর্তি হলেন নেত্রকোনা কলেজে।

এরপরের ইতিহাস বড়োই বেদনাদায়ক। কবি মেধাতালিকায় স্থান পেয়েও ইঞ্জিনিয়ারিং-এ চান্স পেলেন না। কারণটা মর্মান্তিক। ১৯৬৫ সালের সাথে আজকের বাংলাদেশের তফাৎ কতোটা সেটি গুণীরা বলতে পারবেন, আমি শুধু কবির কথাতেই বাক্যটি হজম করি-

ভারত এনিমি স্টেট বলে বিবেচিত। পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুরাও কিয়দংশে এনিমিটিরি দায়ভাগ বহন করে।

ঢেউ গড়াতে গড়াতে কোথায় কোথায় চলে যায়…। খুব অবস্থাপন্ন ঘরের সন্তান ছিলেন না। তাঁর পিতার কোলকাতার আর্ট কলেজে পড়ার সুযোগ হয়েও, ললাটে সেই লেখাপড়া নিস্পত্তির ভাগ্য জোটেনি। তেমনি ভালো ফলাফল করেও কবির ঠাঁই হলো না কোথাও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি বিভাগে ভর্তির জন্য মনোনিত হয়েও দূভার্গের কারণে চূড়ান্ত ভর্তির ভাগ্য হয়নি। অবশেষে, আবার সেই আনন্দমোহন ! ডিগ্রী ক্লাসে সেখানেই ফিরে যান কবি। আর সেই ফিরে আসা আসলে কার কাছে ফিরে আসা হলো সেটি কবি যেভাবে বিবৃতি করলেন, সেটি পড়ে ভাষার মুন্সিয়ানায় মুগ্ধ হওয়া যায় বটে, কিন্তু সমস্ত যুক্তির জাল ফেলেও সেটিকে গ্রহণ করা যায় না।
অবশ্য, আমি আপনি এসব গ্রহণ করার কে? এ তো যার তার জীবন কাহিনি নয়। এটি একজন কবির জীবন কাহিনি। কবি তাঁর অসামান্য গদ্যে লেখেন-

আমি আমার আনন্দ সন্ধানী ইন্দ্রিয়কে দমন করার পরিবর্তে, জগতের আনন্দযজ্ঞের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করি। আমি নবজাগ্রত যৌবনের ডাকে সাড়া দিই – খরতপ্ত গ্রীষ্মের প্রথম বর্ষণের ডাকে ডিমওয়ালা কৈ মাছ যেরকম সাড়া দেয়। আমি সাড়া দিই – উষ্ণ গাভীর ডাকে বির্যবান ষাঁড় যেরকম সাড়া দেয়। আমি সাড়া দিই – মিষ্টদ্রব্যের গন্ধে পিঁপড়ের দল যেরকম সাড়া দেয়। আমি সাড়া দিই – টারজানের ডাকে অরণ্যের হিংস্রপশুরা যেরকম সাড়া দেয়।

এতসব আনন্দযাপন, সঙ্গে সঙ্গে চলছে কবিতা লেখার কাজ। লিখতেন ইংরেজি কবিতা, তবে, পরে সেটি নিয়মিত ছিল না। বাংলা কবিতা ছাপা হতে লাগলো বিভিন্ন পত্রিকায়। কিন্তু কবি তো জীবন বিলিয়েছেন হেলাফেলায় কাছে, সেটির গন্তব্য কোথায় তা শুনতে গিয়ে জগতের সমস্ত সুশীল মুখ স্তব্ধ হয়ে যাবে। কবি বলেন-

মদ্য-পদ্য-সিদ্ধি-গণিকা-জুয়া,- এই পঞ্চভুতের পাদপদ্মে আমি উৎসর্গ করি আমাকে।

দুই.

আনন্দমোহনের আনন্দে আকণ্ঠ নিমজ্জিত কবির জীবনে হঠাৎ করেই এক অদ্ভুত সমস্যা উপস্থিত হয়। নেত্রকোনার বারহাট্টার এক ডাকাত পুলিশের হাতে ধরা খেয়ে সহযোগী হিসেবে যাদের নাম জমা দেন তাদের মধ্যে জ্বলজ্বল করা একটি নাম-নির্মলেন্দু প্রকাশ গুণ চৌধুরী (এই নামটি কাটছাঁট করেই আজকের নির্মলেন্দু গুণ)। জীবন নিয়ে খেলায় নামা কবি শেষ পর্যন্ত ডাকাত দলের সদস্য বনে যাবেন তা নিশ্চয়ই কল্পনায়ও ভাবেন নি। কিন্তু সেটিই ঘটলো। ফেরারী হলেন কবি। আর এই ফেরারী পথই তাঁকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে এলো নতুন ঠিকানায়। আশ্রয় দিলো ঢাকার বুকে।

তিন.

এরপর শুরু হলো ঢাকার জীবন। কেমন ছিল সেই জীবন? লিখতে গেলে মহাকাব্য হয়ে যাবে। ঢাকায় এসেই পুরনো বন্ধু মামুনুর রশীদ (প্রখ্যাত অভিনেতা)-এর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এর ডেরায় উঠেন কবি। মামুনুর রশীদই পরিচয় করিয়ে দেন-কণ্ঠস্বর সম্পাদক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর সঙ্গে। একটি কাজ কবির খুবই দরকার ছিল। সায়ীদ স্যার তাঁকে দায়িত্ব দেন কণ্ঠস্বর এর বিজ্ঞাপন যোগাড়ের কাজে। সায়ীদ স্যারের সাইকেল নিয়ে টইটই করে শহর ঘুরে কবি লেগে যান তাঁর কাজে।

চার.

জীবনের বাঁকগুলো নির্মলেন্দু গুণের ছিল খুবই রোমহর্ষক। কণ্ঠস্বর নিয়ে তাঁর আবেগ যখন তুঙ্গে, তখন আবদুল মান্নান সৈয়দ-এর লেখা বেশি পরিমানে ছাপানোর ইস্যুকে সামনে নিয়ে তিনি কণ্ঠস্বর ত্যাগ করেন। কিন্তু পুরো গ্রন্থে কণ্ঠস্বর-এর প্রতি তাঁর প্রেম আর ভালোবাসা ছিল উল্লেখ করার মতো। বন্ধুদের প্রতি অকৃত্রিম আর সৎ নির্মলেন্দু গুণ বন্ধু গীত গেয়েছেন পুরো বইতেই। তেমন একজন-“চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা” কবি-আবুল হাসান।

আবুল হাসান সহ কী করেন নি নির্মলেন্দু গুণ ! ফুটপাত-মসজিদ-রেল স্টেশন মায় বেশ্যালয় সব জায়গাকেই শয্যার আশ্রয় করেছিলেন। দুজনে ছিলেন কবিতার কর্মী। সারারাত ধরে যত্রতত্র জুয়া খেলা আর কবিতা লেখা, এই ছিল রুটিন কাজ। তবে, আবুল হাসান তেমন একটা জুয়া খেলতেন না। আবার আবুল হাসান না থাকলে নির্মলেন্দু গুণের জীবন যে শুধু জুযা খেলেই কাটতো; কবিতা লেখা আর হতো না, সেটিও কবি উল্লেখ করেছেন। টাকার টানাটানি ছিল নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। টাকার অভাবে তিনবেলা ভাত জুটতোনা। কার প্লেটে ভাত খাচ্ছেন, কার টুথব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজছেন, কোনো খেয়াল নেই। কিন্তু, কবিতার লাইন এলোমেলো হলো কি না, সেটি কিন্তু খুব খেয়ালে থাকতো। এমনই জাত কবি-নির্মলেন্দু গুণ। বিছানা-বালিশ থাকা , না-থাকা নিয়ে কবির অনুভূতি পড়ুন-

বিছানা-বালিশ, গামছা-মশারি, থালা-বাসন এগুলো যে নিজের থাকতে হয়- তা আমি জানতাম, কিন্তু থাকার নির্দিষ্ট জায়গা ও টাকার অভাবে ওগুলো সংগ্রহ করা হয়ে ওঠেনি। আর এগুলো যে আমার নেই তা বুঝতেও আমার বেশ সময় লেগেছিল।

পাঁচ.

প্রেম তাঁর জীবনে এসেছে ভীরু পায়ে। বিশিষ্ট লেখিকা পূরবী বসুকে ভালোবেসেছিলেন। কিন্তু অস্থির আবেগের কথা তাঁকে জানাবার আগেই মাথায় আকাশ ভেঙে খবর আসে সেই নারী আরেকজনের বাগদত্তা। তারপর আবার ভেসে যাওয়া। তারপর আবার গণিকালয়ে যাত্রা। কবি তাঁর স্বভাবগত ভাষায় ঢাকায় আগমণের পরের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেন,

ঢাকায় আসার সময় আমার বাম হাতে ছিল বাবার কিনে দেওয়া একটা ক্যাভেরলি ঘড়ি আর ডান হাতের অনামিকায় ছিল ঝিলমিল-পাথর বসানো একটি চার আনা স্বর্ণের আঙটি। এই নগরী প্রথম সুযোগেই ও দুটো আমার হাত থেকে পর্যায়ক্রমে খুলে নেয়। বাবার ঘড়িটি যায় জুয়ার আড্ডায়, আর নাম- ভুলে যাওয়া সুদর্শন পাথর বসানো আমার ঐ সুবর্ণ-অঙ্গুরীয়টি গ্রাস করে পুরনো-ঢাকার অবলা মাসির মেয়েরা। এর পর যথার্থ অর্থেই আমি ছিলাম একেবারে ঝাড়া হাত-পা। কবিতার পান্ডুলিপি ছাড়া আগলে রাখার মতো আর কিছুই ছিল না।

ছয়.

গ্রন্থে যেভাবে কবি নির্মলেন্দু গুণ জীবনকে দেখিয়েছেন, সেসব দেখে মনে হলো- জীবন নিয়ে যেন একধরনের রসিকতাই করে গেলেন কবি। আমাদের যেসব কবি, লেখকরা প্রতিষ্ঠা আর সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠাকে জীবনের প্রধান কর্ম ধরে নিয়ে তারপর সাহিত্য রচনা করছেন, তাদের কাছে এ-এক স্পর্ধিত বিস্ময় হয়ে থাকবে; যখন দেখা যায়, তুড়ি মেরেই কবি কাটিয়ে দিলেন একটা জীবন।

হুলিয়া কবিতাটি লিখে প্রসিদ্ধ হওয়া কবি নির্মলেন্দু গুণ এর এমনতর জীবন কাটানো নিয়ে আলোচনা হতে পারে, চায়ের টেবিলে ঝড় উঠতে পারে অনেক, কিন্তু প্রকৃত অর্থেই সাহসী কলমে ধুলোর মাঝে গড়াড়ড়ি দিয়েও জীবনের যে জয়গান কবি নির্মলেন্দু গুণ আলোচ্য গ্রন্থে করলেন, তা সবাই পারে না। আমরা ইতিমধ্যে কারো কারো আত্মজীবনীর নামে অক্ষম প্রচেষ্টা দেখেছি, কিন্তু সত্য উচ্চারণ উল্লেখযোগ্যভাবে কবি নির্মলেন্দু গুণই করলেন। তাই, কবি নির্মলেন্দু গুণ, আপনি জানেন কি না জানি না, এখানে কিন্তু সবাইকে হারিয়ে দিলেন আপনি।

Posted in রিভিউ | 4 টি মন্তব্য

আমার আত্মজীবনী পাঠ- দ্বিতীয় পর্ব

‘‘কবিরা বোধহয় সবাই উন্মাদ। এক ধরনের পাগলামির সঙ্গে কবিতার একটা বন্ধুত্ব আছে। যুক্তিসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষে কবি হওয়া যেমন শক্ত, কবিদের পক্ষে ততোধিক কঠিন যুক্তিসম্পন্ন মানুষ হওয়া।” পাবলো নেরুদা তাঁর জীবনীগ্রন্থ-“Memoirs” (অনুস্মৃতি)-এ কবি বলতে এ-ধরনের একটি চরিত্রকে পাঠকের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। এই সংজ্ঞার দর্পনে নেরুদার মুখটি প্রতিস্থাপন করলে ঠিক এরকম একটি চরিত্রকেই খুঁজে পাওয়া যাবে- যিনি প্রকৃতই যুক্তিহীন, বোহেমিয়ান, স্বাপ্নিক, প্রেমময় আর উদ্দাম একটি জীবন কাটিয়ে গিয়েছেন।

কবিদের জীবন কী এমনই হয় ! যদি বলি, নেরুদা যেন কাটিয়ে গিয়েছিলেন একটি কবিরই জীবন। পাগলামি, দুষ্টুমি, অযত্ন একদিকে, আরেকদিকে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়ে বিপ্লবের পথে হাঁটার কারণে দেশ ছেড়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ানো। কিন্তু, জীবনের শেষ বেলায় যখন কবিতার জন্যই ১৯৭১ সালের ২১ অক্টোবর নোবেল পুরস্কার পেলেন নেরুদা, ১৩ ডিসেম্বর স্টকহোমে ভাষণ দিতে ওঠেন কবি, সেখানে তথাকথিত ভাষণের কোনো লেশমাত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেদিন তিনি তাঁর কবিতার জন্য সংগ্রাম, তাঁর দেশের জন্য সংগ্রাম নিয়ে অবিস্মরণীয় একটি বক্তৃতার মালা সাজিয়ে যেন আরেকটি কালজয়ী কবিতার জন্ম দেন। তাইতো, নেরুদাকে বিশ্বের অন্যতম সেরা কবির পদমর্যাদা দিলে অত্তুক্তি হয় না। নেরুদা প্রেম আর বিপ্লবের কবিতা লিখে স্মরণীয় হয়েছেন। তাঁর প্রেমের কবিতা জীবন্ত, প্রাণবন্ত, তীব্র কামনার ঘোরে আঁকা। আর তাঁর বিপ্লবের কবিতা যেন কবিতার ফ্রেমবন্দি নির্দোষ কোনো শব্দবন্ধ নয়, সেগুলো সবই এক-একটি আগুনের ফুলকি। প্রেম আর বিপ্লবের কবি তাঁর জীবনীগ্রন্থ নিজের জীবদ্দশায় বের করে যেতে করতে পারেন নি। নেরুদার মৃত্যুর পর তাঁর তৃতীয় স্ত্রী মাতিলদে নেরুদা ও মিগুয়েল ওতেরোর উদ্যোগে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবির মালা যার গলায় পরানো হয়, সেই লোকটির আত্মজীবনীগ্রন্থটিও একইভাবে আদরণীয়। বিশ্বের কয়েকটি সফল জীবনীগ্রন্থ নিয়ে ছোট তালিকা করলে মেময়র্স বা অনুস্মৃতি অনায়াসে জায়গা করে নেবে।

১২ জুলাই ১৯০৪ সালে দক্ষিন চিলির একটি অখ্যাত গ্রামে জন্ম নেয়া শিশুটির পিতা ছিলেন একজন সামান্য রেল ইঞ্জিন চালক। বেড়ে উঠেছিলেন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। সেই পরিবিশে বেড়ে উঠে তিনবেলা খাবার জুটানোই যেখানে ছিল কঠিন কাজ, সেখানে কবিতা লেখা তো অনেক দূরের বিষয়। এমনকি যখন নেরুদা স্প্যানিশ ভাষায় কবিতা রচনা শুরু করেন, তখন তাঁর পিতার কঠোর বাধার মুখোমুখি হন। এমনকি স্বনামেও কবিতা লিখতে পারেন নি তিনি। আশ্রয় নিতে হয়- পাবলো নেরুদা ধরনের একটি ছদ্ম নাম রাখার, যেটি দেখে পিতা বুঝতে পারবেন না কবিতাটি তাঁর পুত্রেরই লেখা। নেরুদার আসল নাম-নেফতালি রিকার্দো রেইয়েস বাসোআলতো। বিপ্লবের পথ ধরে যখন পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন তখন ছদ্মনাম নেন-সেনিওর লেগাররেতা।

সারা জীবন কবিতা লিখে গেছেন নেরুদা। তাঁর সারাটা জীবন বিপ্লবেরও। জীবনে কবিতা আর নারী পাশাপাশি ছায়া রেখে চলেছে। কবিতার নারীরা তাঁর জীবনে এসেছে, চলে গিয়েছে। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ নেরুদার মনের ওপর পদছাপ রেখে গেছেন, কেউ কেউ রাখতে পারেন নি। তবে, তাঁর জীবনে দোল খাওয়া প্রায় সব প্রেম নিয়েই তিনি কবিতা রচনা করেছেন। সেসব কবিতা এতটাই প্রেমময় আর দেহজ যে, নেরুদাকে শরীর সর্বস্ব পুরুষ বলে চিহ্নিত করলে মিথ্যে বলা হয় না। সবকিছুর সরল স্বীকারোক্তি প্রদানও নেরুদার অন্যতম বৈশিষ্ট বটে। নেরুদার নারী সম্ভোগের কাহিনি মানুষের মুখে মুখে ফেরে। আত্মজীবনীতেও নেরুদা সেসব আড়াল করেন নি। বরং ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে মাঝে-মধ্যে কৌতুককর আর কৌতুহল উদ্দীপক নানা পরিস্থিতির উদ্রেক করেছেন। তাঁর জীবনে প্রথম নারী সম্ভোগের নায়িকাকে তিনি চেনেন না, জানেন না। তিনি খুব বেশি নিশ্চিতও নন, কে সেই নারী। এমন মজার আর অদ্ভুত একটি ঘটনা গ্রন্থের শুরুতেই লেখা হয়েছে। তিনি তখন নিতান্তই বালক অবস্থা থেকে যৌবনে পদার্পন করেছেন। স্থানীয় এর্নান্দেসরাদের একটি খামারে পথ চলতে গিয়ে ভিড়ে গিয়েছিলেন। নিমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে তাদের সাথে গম মাড়াই করা, গান করা, গলা অব্ধি মদ গেলা সবই চলতে থাকে। রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষে পুরুষদের জন্য শোবার নির্ধারিত স্থান খড়ের গাদায় শুয়ে পড়েন নেরুদা। মেয়েরা শুয়েছিল তাবুতে। সবাই যখন ঘুমে অসাড়, তখন নেরুদা টের পান একটি নারী দেহ তাঁকে পেঁচিয়ে ধরেছে। প্রথমে কি না কি ভেবে তিনি ভয় পেয়েছিলেন, কিন্তু পরে নারীটির আহবানে সাড়া দিয়ে চমৎকার একটি রাত্রি যাপনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। ঠিক এরকমই, যখন যে জায়গায় গিয়েছেন সবখানেই নেরুদা নারী সঙ্গী জুটিয়ে নিয়েছিলেন। সেসব নারীরা জীবনীগ্রন্থে অনেক জায়গা দখলে নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু কবির মনে কতটুকু রেখাপাত করেছিলেন তাতে আমি সন্দিগ্ন। শুধু একজনা। একজন নারীর কথা নেরুদা বিশেষভাবেই তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছেন। আমাদের প্রান্তবর্তী দেশ বার্মার মেয়ে যোসি ব্লিস নামের সেই মেয়েটি বার্মার রাষ্ট্রদূত থাকাকালে নেরুদার সঙ্গীনি ছিলেন। প্রেমের আরেক নাম তো জ্বালাতন। নারীটি নেরুদার প্রেমে মুগ্ধ হয়ে রাতদিন তাঁকে নিয়েই থাকতে চাইতেন। শুধু তাই নয়, নেরুদা কারো সাথে কথা বলুক, মিশুক তা-ও যোসি ব্লিস চাইতেন না। প্রেম যখন এমনতর যন্ত্রণায় রূপান্তরিত হলো তখনই নেরুদা তাকে ছেড়ে যান। ছেড়ে গেলেও নেরুদার জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত যোসি ব্লিস তাঁর মনে ছিল আদরের, প্রিয়তার সবগুলো উপাদান নিয়েই। আমরা যখন নেরুদার কবিতা পড়তে যাই, তখন দেখি যোসি ব্লিসকে নিয়ে লেখা হয়েছে কবিতার পর কবিতা। ড. সফিউদ্দিন আহমদ এর অনুবাদে দুটি কবিতার শিছু অংশ পড়া যাক।

ব্লিস তোমাকে খুব মনে পড়ছে-ভীষণ মনে পড়ছে তোমাকে।
হ্যাঁ ব্লিস, আমার জানতে ইচ্ছে করছে, শেষতক তোমার কী হয়েছিল !
সেই যে যুদ্ধ, মহাতান্ডবের যুদ্ধ,
পুড়ে, ছাইভস্ম করে দিল উজ্জ্বল আলোকিত সুসজ্জিত শহরটাকে-
হায় ব্লিস ! তুমিও কি মিশে গেলে এই ছাইভস্মে?

আরেকটি,

ব্লিস-
জ্বলে উঠেছিল আগুন
যেন দাবানল,
আমি ছিলাম না তখন-
এখন হয়তো বা কবরেও নেই তুমি
মৃত্যুতে মহাযাত্রায় আজ সাবলীল
আর আমার ভালোবাসাও হলো
চির বিচ্ছেদের চিতায় বিদায়-
এখন চিতা বহ্নিমান কেবল আমার হৃদয়ে।

জীবনে মোট তিনবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। প্রথমবার বিয়ে করার কারণ নেরুদা তাঁর আত্মজীবনীতে এভাবেই তুলে ধরেছেন-“অসহনীয় নিঃসঙ্গতায় যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে বিবাহ করার জন্য মনস্থ করলাম। আধাডাচ-আধামালয়ী দীর্ঘাঙ্গী এক সুন্দরীকে- যাঁর নাম মারিয়া আন্তোনিয়েতা হ্যাগনার।” ব্যস। এটুকুই। এই নারীটকে নিয়ে পুরো জীবনীগ্রন্থজুড়ে নিজের আর কোনো অভিব্যক্তি নেরুদা প্রকাশ করেন নি। সংসারযাপনের কথা তো নয়ই, এমনকি সেই নারীর সঙ্গে কখন বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেল, সেটিও নয়! দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে রয়েছে একটিই বাক্য- ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল গোছের বিবৃতি সেটি। তবে তৃতীয় স্ত্রী মাতিলদে তাঁর স্বপ্ন, কল্পনার সবটুকুই দখল করে নিয়েছিলেন। নেরুদার কবিতাগ্রন্থগুলো পড়লে দেখা যায়, মাতিলদেকে নিয়ে লেখা রয়েছে অসংখ্য কবিতামালা।

চিলির বানিজ্যদূত, রাষ্ট্রদূত হিসেবে নেরুদা পৃথিবীর নানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। ভারতবর্ষ ভ্রমণে তাঁর দুবার দুরকম অভিজ্ঞতা হয়। পরাধীন ভারতে গিয়ে মানুষের আন্তরিকতায় মুগ্ধ হন নেরুদা। তিনি সেখানকার মানুষ, তাদের সংস্কৃতি আর ব্রিটিশদের দ্বারা ভারতীয়দের শাসন আর নির্যাতনের কারণে ব্রিটিশদের প্রভু আর ভারতীয়দের দাসানুদাস নামক একটি সম্পর্কিত অবস্থা অনুধাবন করে ব্যাথিত হন। নেরুদা বলেন, “ব্রিটিশ প্রভু আর তাদের দাসানুদাস প্রজাদের মধ্যেকার এই ভয়ঙ্কর ফাঁক পূরণ করার চেষ্টা ব্রিটিশরা কোনও সময়ই করেন নি, আর এই অমানবিক বিচ্ছিন্নতার জন্যেই প্রাচ্যের মানুষদের সমাজ-সংস্কৃতির কোনও মূল্যায়নই ওদের দ্বারা হয়নি।” স্বাধীন ভারতে গিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা হয় একদম বিপরীত। তখনকার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর অসৌজন্যমূলক আচরণ আর রূঢ় ব্যবহারে নেরুদা ভারত থেকে প্রায় পালিয়ে এসেছিলেন। এমনকি জীবনে একটিবার তাজমহল দেখার স্বাধটিও পূরণ হয়নি তাঁর।

ভারতের রাজনীতি, রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে নেরুদার মূল্যায়ন ছিল কখনো নির্লিপ্ত ভঙ্গির কখনো আন্তরিক আর গভীর। এদের মধ্যে গান্ধিজী সম্পর্কে একটি উক্তি না বললেই নয়। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় তাঁর ডায়েরিতে মহাত্মা গান্ধি সম্পর্কে বলেছিলেন,

সে অনেক দিন হল ঋত্বিক ঘটক বলেছিল, গান্ধিজী একটি আদ্যন্ত শুয়োরের বাচ্চা

আর নেরুদা তাঁর আত্মজীবনীতে গান্ধিজী সম্পর্কে বলেছেন,

গান্ধিজীর মুখ ধুর্ত শেয়ালের মতো

নির্বাসন জীবনে কমরেড নেরুদা রচনা করেছেন অসংখ্য কবিতা। মাঝে-মধ্যেই সেই জীবনের যন্ত্রণায় মুষড়ে পড়তেন তিনি। সুভাষ মুখোপাধ্যায়-এর অনুবাদে এ-ধরনের একটি কবিতার কিছু অংশ পড়া যাক-

আমি শুধু জানি পাখিদের হারানো জিনিস,
পেছনে ফেলে আসা সমুদ্র কিংবা আমার বোনের কান্না।
কেন আলাদা এত অঞ্চল, কেন দিনের
পায়ে পায়ে দিন আসে ! কেন কালোর রাত
মুখের মধ্যে ঘনায়? মৃতের দল কেন?

এবার ড. সফিউদ্দিন আহমদ-এর অনুবাদে বিপ্লবের কবিতার চারটি লাইন:

দীপাধারে জ্বলে উঠবে আগুন, লালে লাল আগুন
কয়লাখনির ধোঁয়া বিপ্লবের আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ছে
বিপ্লবের অঅগুনে শত্রুকে ছাই করে
তবেই আমাদের সংগ্রাম থামবে।

একজন কবি যখন কবির জীবনই কাটিয়ে যান তখন আসলে মুগ্ধ হয়েই দেখতে হয়। পা থেকে মাথা পর্যন্ত কবি পরিচয়ধারী নেরুদা নিজের জীবন আর কবিতা নিয়ে কী ভাবতেন, পাঠকের মনে যদি এই প্রশ্নটি জাগে, তবে, নেরুদার উক্তি দিয়েই লেখাটি শেষ করি-

“আমার কবিতা ও আমার জীবন চিলির খরস্রোতা জলের ধারাটিকে সঙ্গে নিয়ে দক্ষিণ আমেরিকায় জন্মলাভ করে আমেরিকার খরস্রোতা একটি নদীর মতো বয়ে চলে। সেই নদীর দুই তটে যা কিছু ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে, যা কিছু জন্মেছে, সবই সে গ্রহন করে আপন ধারায় বয়ে নিয়ে সমুদ্রে এসে মিশেছিল। আসক্তি, রহস্য, ভালোবাসা- সব কিছু নিয়েই সে মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করেছিল।”

বইটি যারা পড়তে চান, অনুবাদকর্ম: অনুস্মৃতি, ভবানীপ্রসাদ দত্ত। বেরিয়েছিল একুশে থেকে। একুশে এখন অবলুপ্ত হয়েছে। কিনে নিয়েছে প্রথমা প্রকাশনী। বইটি প্রথমায় পাবেন।

Posted in রিভিউ | 4 টি মন্তব্য

আমার আত্মজীবনী পাঠ- প্রথম পর্ব

বিখ্যাত ইংরেজ কবি-সমালোচক-নাট্যকার ড্রাইডেন বায়োগ্রাফি বা জীবনীর স্বরূপ চিহ্নিত করতে গিয়ে একে “বিশেষ মানুষের জীবনের ইতিহাস” বলে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন। বোধ করি এটিই বায়োগ্রাফির গ্রহনযোগ্য সংজ্ঞা। “বিশেষ মানুষের” জীবনের ইতিহাস হিসেবে যখন আত্মজীবনী গ্রন্থটি বাক্যবন্দি হয়, তখন কে’ বা কার দ্বারা এ-ধরনের গ্রন্থ লিখিত হবে সেটি নির্দিষ্ট হয়ে যায়। ইংরেজি ভাষায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী রচিত হয় চতুর্থ খ্রিষ্টাব্ধে। সেন্ট অগাস্টিনের-“কনফেশন্স।”

ছোটবেলা থেকে বিখ্যাত মানুষদের জীবনীগ্রন্থ সংগ্রহ করা এবং পড়া আমার অন্যতম পছন্দের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহুবছর ধরে আমি আত্মজীবনী গ্রন্থ সংগ্রহ করছি, পড়ছি। আত্মজীবনী প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে হুমায়ুন আজাদ তাঁর একটি প্রবন্ধে বলেছিলেন, “আত্মজীবনী এক ধরনের উপন্যাস, এক ধরনের রিমেমব্রান্স অফ থিংজ পাস্ট” (সীমাবদ্ধতার সূত্র, পৃ ৬২)। কথাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এই অর্থে যে- তিনি আত্মজীবনীকে আত্মজৈবনিক উপন্যাস হিসেবে মূল্যায়ন করেছিলেন। একটি আত্মজীবনী যদি সুলিখিত এবং গ্রহনযোগ্য হয়, তবে এটি সফল একটি উপন্যাসের জায়গা দখল করতে পারে তা বলাই বাহুল্য। অবশ্য প্রবন্ধটিতে তিনি বাংলা ভাষায় লিখিত আত্মজীবনীগুলোর ব্যাপারে তাঁর হতাশা ব্যক্ত করে ওগুলোকে মোটামুটি উড়িয়ে দিয়েছিলেন। হুমায়ুন আজাদ উড়িয়ে দেবার মত ক্ষমতাশালী লেখক। আমি সাধারণ পাঠক। বাংলায়ও যে সফল আত্মজীবনী লিখিত হতে পারে সেটি বেশ কয়েকজন বাঙালি রীতিমত দেখিয়ে দিয়েছেন। সেসব আত্মজীবনী নিয়ে এবং আমার পড়া শ্রেষ্ঠ আত্মজীবনীগ্রন্থগুলো নিয়ে একটি সিরিজ করার ইচ্ছে থেকেই এ-লেখা শুরু করা।

ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজে কেন আত্মজীবনী পড়ি এই প্রশ্নটি নিজেকে করে যে উত্তরটি পেয়েছি তা হল- একজন মানুষ যখন সফল হন তার সাফল্যের পেছনে অবশ্যই অনেক ইতিহাস থাকে। অনেক সংগ্রাম থাকে, ত্যাগ থাকে, নিষ্ঠা থাকে, পরিশ্রম থাকে। কেউ তো রাতারাতি খ্যাতিমান বা সফল হয়ে যান না। এই খ্যাতি বা সাফল্য একজন মানুষের জীবনে কীভাবে আসে সে-সব জানতে আমি আত্মজীবনী পড়ি। কেউ কেউ বলেন, আত্মজীবনীতে মানুষ নিজেকে মহান করে দেখায়, মিথ্যে কথায় ভরা থাকে আত্মজীবনী। কথাটিকে যদি মেনেও নিই, তবু এ-কথাটি বলা যায়, কেউ নিজে কিছু বানিয়ে লিখলে সেটি সত্যি হয়ে যায় না। তথ্যজানার সুবিধে আর সহজে যোগাযোগ স্থাপনের এই সময়ে বিখ্যাত ব্যক্তিদের কোনো কিছু অজানা থাকে না। তাই, বিখ্যাত ব্যক্তিদের লেখা পড়ে এবং তাঁর সম্পর্কে অন্যদের মূল্যায়ণ পড়ে একটি ধারনা যদি নেয়া যায় তবে সেটি ভাল বই খারাপ হবার নয়, এবং একটি প্রায় পূর্নাঙ্গ ধারনা এভাবে নেয়া সম্ভব।

হুমায়ুন আজাদের প্রবন্ধটিতে বাট্রার্ন্ড রাসেল এবং পাবলো নেরুদার আত্মজীবনী গ্রন্থের কথা বলা হয়েছে- সফল অর্থে। দুটো গ্রন্থই পাঠের সুযোগ আমার হয়েছে। এ-পর্বে রাসেল-এর আত্মজীবনীগ্রন্থের কথা বলা যাক।

রাসেল-এর আত্মজীবনী-“দ্য অটোবায়োগ্রাফি অব বাট্রার্ন্ড রাসেল”কে পৃথিবীর ইতিহাসে এ-পর্যন্ত লিখিত আত্মজীবনীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ আত্মজীবনী বলা হয়ে থাকে। বিখ্যাত এই মনীষীর তিনখন্ডের আত্মজীবনীটিতে শুধু একজন ব্যক্তির জীবনের খুঁটিনাটি লেখা নেই, লেখা আছে একটি কালের ইতিহাস। ১৮৭২ সালে জন্ম নেয়া রাসেল মৃত্যুবরণ করেন ১৯৭০ সালে। বিয়ে করেছিলেন চারটি। ১৯৫০ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন তিনি।

তাঁর প্রকৃত নাম বার্ট্রান্ড আর্থার উইলিয়াম রাসেল। তাঁর পিতামহ লর্ড জন রাসেল দুইবার ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হন। বয়স পাঁচ-এ না যেতেই রাসেল তাঁর মা-বাবা দুজনকেই হারান। বিবাহিত জীবন ছিল ঘটনাবহুল। ১৮৯৪ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে বিয়ে করেন এ্যালিস পিয়ারসলকে। ১৭ বছর পর বিচ্ছেদ ঘটে সেই বিয়ের। দ্বিতীয় স্ত্রী ডোরা উইনফ্রেড ব্ল্যাক। এটিও টেকেনি। বিয়ের ১৪ বছর পর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় দুজনার। ১৯৩৫ সালে বিয়ে করেন প্যাট্রিসিয়া স্পেন্সকে। এটিই শেষ নয়। চতুর্থ বারের মত বিয়ের টোপর পরেন ৮০ বছর বয়সে। বিয়ে করেন এডিথ ফিন্সকে। এ বিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত, মানে ৯৮ বছর বয়স পর্যন্ত টেকে।

জীবনের আলোকিত দিকটি শুধু নয়, নিজের জীবনের অন্ধকার দিকের কথাও রাসেল তাঁর আত্মজীবনী গ্রন্থে লিখে রেখে গেছেন। বয়ঃসন্ধিতে শারীরিক পরিবর্তনের যে অভিজ্ঞতা সেটি তাঁর মনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। স্বমেহনের অভ্যেস বিশ বছর পর্যন্ত বজায় রেখে তিনি মনে মনে পুড়তেন। এটি বন্ধ করার অভিপ্রায়ের কথাও বলেন। যখন প্রেমে পড়েন তখন এটি বন্ধ হয়ে যায়। নারী শরীরের প্রতি অতি আগ্রহ নিবারণে নানা কায়দাকানুনের আশ্রয় নিতেন। একসময় এসব নিয়ে দহনে পুড়লেও গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান অর্জন মনে করে একে মানসিক ব্যাধিগ্রস্থতা বলে মনে করতেন না। নারী শরীরের প্রতি মোহমুগ্ধতার কারণেই একসময় কবিতার প্রেমে পড়ে যান। ষোল-সতের বছর বয়সেই মিলটন, বায়রণ, শেলীর কবিতা পড়ে শেষ করেছিলেন।

ছোটবেলা থেকেই গণিতের প্রতি মোহগ্রস্থতা ছিল। প্রচন্ড ভাবুক ছিলেন। ষোল বছর বয়সের একটি অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বলেন, একাকী ঘুরে বেড়ানোর প্রতি আকর্ষণ ছিল। সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে তাঁর যখন-তখন আত্মহত্যা করার ইচ্ছে জাগতো। তিনি আত্মহত্যা করেন নি, কারণ, গণিত সম্পর্কে তাঁর জানার আকাঙ্ক্ষা অটুট ছিল।

জীবনীগ্রন্থের শেষ প্যারায় নিজের জীবনের ব্যর্থতাগুলোকেও তাঁর নিজের অর্জন বলেই মনে হয়েছে, তিনি বলেন, আমি আসলে এসব সত্ত্বেও বিজয়ী হয়েছি। তাত্ত্বিক সত্যকে কখনো কখনো অস্বীকার করলেও অন্য এক ধরনের সত্যকে তিনি নিজের জীবনের পাথেয় করে নিয়েছিলেন। জীবনযাপনে ব্যক্তিগত লক্ষ্য এবং সামাজিক লক্ষ্য দুই-এর মাঝে আনুপাতিক সমঝোতা স্থাপনের মাধ্যমে একটি সফল জীবন কাটানোর জন্য তাঁর তৃপ্তিবোধের কথা তিনি উল্লেখ করেন। ১৯৬৯ সালে লেখা তাঁর আত্মজীবনী গ্রন্থের শেষপ্রান্তে তিনি সেই সময়ের সমাজকে বিপজ্জনক বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন, নতুন নতুন চিন্তা, আশা, নতুন ধরনের স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতা থাকলেও তার ওপর নতুন ধরনের নিয়ন্ত্রন আরোপ করা খুবই প্রয়োজন।

পুরো আত্মজীবনী গ্রন্থে অসংখ্য পত্রাবলী জুড়ে দেয়া হয়েছে। এসব চিঠি পড়ে রাসেলকে গভীরভাবে জানার সুযোগ ঘটে। একজন গণিতশাস্ত্র বিশারদ, একজন দার্শনিক হিসেবে খ্যাত হলেও তিনি ছিলেন একজন নীতিনিষ্ঠ মানবাতাবাদী। আজকের পৃথিবীতে স্বল্পজ্ঞানকে পুঁজি করে বিখ্যাত হবার যে প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায়, সেদিক বিবেচনায় নিলে রাসেল ছিলেন একজন আশ্চর্য ব্যতিক্রম। তিনি বিখ্যাত সব গ্রন্থেরও রচয়িতা। “প্রিন্সিপালস অব ম্যাথম্যাটিকস”, ”হিস্টোরি অব ওয়েস্ট্রার্ণ ফিলোসফি” “দ্য কনকোয়েস্ট অব হেপিনেস”, “ম্যারিজ এন্ড মরালস”, “হোয়াই আই এ্যাম নট এন ক্রিশ্চিয়ান” ইত্যাদি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

“ম্যারিজ এন্ড মর‌ালস” বইটি পাঠের সুযোগ আমার হয়েছে। এত আধুনিক চিন্তাধারা ছিল তাঁর, বইটি পড়তে গিয়ে প্রথাগত জীবনের নানা আচারের অর্থহীনতায় মানুষ বারবার ভাবতে বসবে। বইটি সম্পর্কে কিছু ধারনা দেয়া যাক।

রাসেল বলেছেন, একালের নৈতিকতার উৎস দুটি; পিতৃত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হবার আকাঙ্ক্ষা এবং যৌনতা সম্পর্কে খারাপ ধারনা। রাসেল অবাধ যৌনতাকে খারাপ বলে চিহ্নিত করেন নি। কিন্তু একইসাথে তিনি আত্মসংযমের কথাও বলেছেন। এক্ষেত্রে আবার সংযমের সঙ্গে যেন ব্যক্তি স্বাধীনতার বিরোধ না ঘটে সেটাও তিনি নিশ্চিত হতে বলেছেন। বিবাহের মূল লক্ষ্য সন্তান পালন- এটা রাসেলের মতামত। সন্তান পালনের ব্যাপারটা না থাকলে তিনি বিবাহের পুরোই বিরোধী হতেন বলে জানিয়েছেন।

পৃথিবীজুড়ে আদি থেকে গঠিত বৈবাহিক সম্পর্ক, পারিবারিক সম্পর্ক, ক্ষমতা, প্রেম, নৈতিকতা নিয়ে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ প্রদান করেছেন বার্টান্ড্র রাসেল। যিনি একাধারে দার্শনিক, গণিতজ্ঞ, বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিজ্ঞ, নীতিবিশারদ এবং ইংরেজি সাহিত্যের একজন শ্রেষ্ঠ গদ্য লেখক ছিলেন।

বইটি কয়েকটি অধ্যায়ে রচিত। সেসব থেকে আমরা যদি মূল বিষয়গুলোকে বের করে আনতে চাই তাহলে যে পয়েন্টগুলো আসতে পারে তা একে একে তুলে দিলামঃ

১) মাতৃতান্ত্রিক সমাজ আর পিতৃতান্ত্রিক সমাজের চিত্র দেখাতে গিয়ে তিনি পিতৃতান্ত্রিক সমাজকে সব সমস্যার মূল রূপে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেন, ঈর্ষা ব্যাপারটা যে পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে অত্যন্ত প্রবল তার কারণ এই ভীতি যে, উত্তরপুরুষ যদি তার ঔরসজাত না হয়। পিতৃতান্ত্রিক পরিবার সূচিত হবার পর থেকে পুরুষরা নারীর কৌমার্য অটুট রাখা নিয়ে মনোযোগী হন। বিবাহের বাইরে যৌনসঙ্গম অন্যায় বলে পরিগণিত হবার পর পরপুরুষের সঙ্গে সহবাসকে সহজভাবে দেখানোর অবসান হয় বলে তিনি জানান। আজকের দিনেও চীনে পুত্রবধুরা শাশুড়ির অত্যাচারে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন পিতৃতান্ত্রিক পরিবার প্রথার কারণেই। ফ্রান্সে পাত্র ক্রয় করার নিয়ম আছে। রোমান ক্যাথলিকরা বিবাহ বিচ্ছেদ একেবারে অনুমোদন করে না। প্রাচীন চীনে আইন ছিল স্ত্রী বাচাল প্রকৃতির হলে স্বামী তাকে তালাক দেবার অধিকার পাবে।

২) মাতৃতান্ত্রিক সমাজ তাঁর পছন্দের। রাসেল বলেছেন, ট্রবিয়ান্ড দ্বীপের লোকেরা পিতা নামক কোনো বস্তুর অস্তিত্ব জানতো না। এক্ষেত্রে তিনি ম্যালিনাউস্কির রেফারেন্স দিয়ে চমৎকার একটি তথ্য দিয়েছেন। সে দ্বীপের কোনো লোকের স্ত্রী যদি অন্য কারো সন্তান গর্ভে নেন তবে সে লোক তাতে কিছুই মনে করে না, বরং খুশী হত। সতীত্ব শব্দটা তারা জানেই না।

৩) সংসারে সন্তান আসার পর স্বামী-স্ত্রীর সুসম্পর্ক রাখা জরুরী বলে তিনি মনে করেন। এজন্য আত্মসংযম দরকার হলে সেটা মেনে নিতে তিনি পরামর্শ দেন। শুধু অবিশ্বস্ততা নয় হিংসা, ক্রোধ, বদমেজাজকে সন্তানের জন্য বিসর্জন দিতে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন। পিতা-মাতার মধ্যে কলহ হলে সন্তানের স্নায়ুর ওপর চাপ পড়ে। পিতা-মাতার ঝগড়ার ঘটনা সন্তানদের কাছে গোপন রাখতে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন। এ-জন্য বিবাহ টেনে না নিয়ে বিচ্ছেদের পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

Posted in রিভিউ | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

দিনগুলো…

ললিতমোহন দাস লেন ধরে এগুচ্ছে রিকসাটি। রিকসা চালকের পায়ের ধাক্কায় রিকসার প্যাডেল ঘুরছে বনবন। তাগড়া জোয়ান রিকসাচালক নানা কসরত দেখিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে এগিয়ে চলেছে গন্তব্যে। তার নয়, আমার। অথবা আমার এবং তার। একটু আগে গনকটুলি লেনে তালগোল পাকানো গোছের জ্যাম পেরিয়ে এসেছে সে। রাস্তা ফাঁকা হতেই বাম হাতের চেটোয় ঘাম মুছে আবার বনবন করে প্যাডেল ঘুরানোর কসরতে মন দেয়। ততক্ষণে আমি আবার বইতে মনোনিবেশ করেছি। রিকসায় উঠেই বইটা মেলে ধরেছিলাম, এক কি দু’পাতা পড়েছি, আর ঝপ করে গতরাতের স্মৃতি মনে পড়ে যায়। রাত তিনটা অবধি স্মৃতির ওলট-পালট। এবং রাতের গভীরে ডুবে যাওয়া, আরও কত কি! অথচ গতকালের দিনটি ছিল বিষণ্নতা গলে গলে পড়ার মতো। মনের ভেতর স্যাতস্যাতে আবহাওয়া আর গুমোট কান্না। সে অবস্থাটি বহাল রইলো সারাক্ষণ। মন খারাপের বিষয়টা গলার কাছে পাক খেয়ে ঘুরছিলো যখন, খুব দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। মনের ওপর এতো চাপ…। আর, অথচ, ললিতমোহন দাস লেনের তিনতলা, অচেনা একটি বাড়ির রঙের বাহুল্যে ভরা দেয়ালের কোল ঘেষে যখন রিকসাটি থামলো আবার, মনের নির্ভার হবার পালা শুরু হলো! মনে হলো মনের মধ্যে ঢাঁক আর বাজনা-বাদ্যির আসর বসেছে ! অথচ, কালকেই কতো বিষণ্নতা…আর আজকে সকাল হতেই মনে প্রশান্তি খেলা করছে! এই অদ্ভুত, আপাত অর্থহীন রোদ-বৃষ্টির মন নিয়ে ভয়ানক জ্বালা দেখি!
কতদিন ধরে বিতিকিচ্ছিরি জ্যাম আর ঝামেলা পেরিয়ে অফিসে যেতে হচ্ছিলো আমার। কিছুদিন আগে এক কলিগ এই রিকসার পথটা চিনিয়ে দিলো। শহরের মূল সড়কগুলো এড়িয়ে, কিছুটা শর্টকাটে এই পথটা এতোদিন কেনো আমার কাছে অনাবিষ্কৃত ছিল তা ভেবে অবাক হই। রিকসায় চড়ে বেড়াতে খুবই ভালো লাগে আমার। শহরের জ্যাম ছাড়িয়ে যখন অফিস যেতাম তখন হতাশায় মুষড়ে পড়তাম। গাড়িগুলো যখন আমাকে ফেলে সাঁইসাঁই করে চলে যেত তখন আমার মরে যেতে ইচ্ছে করতো। ঘড়ি ঘুরছে অথচ আমি তখনো কীভাবে অফিসে যাবো তা-ই জানি না। তারপর যখন কিছু একটায় ওঠার সৌভাগ্য হয়, তখন দেখি ভয়ানক জ্যাম শহরটাকে গলা চেপে ধরে আছে। এই জ্যাম আর ভিড়ের শহরে রোজকার অফিস যাত্রা আমাদের ক্লান্ত ক্লান্ত করে। অথচ পরিস্থিতি এখন আর তেমন নেই। সকালের এই রিকসা জার্ণি এক চমৎকার রিলিফ যেন। লম্বা একটা জার্ণি যদিও। একঘেয়েমি দূর করতে কোনো কোনোদিন বই পড়ি, কোনোদিন কিছুই করি না। স্রেফ বসে থাকি আর চারপাশের মানুষগুলোর মুখ দেখতে থাকি। তাদের মুখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করি। কারো চোখে হাসি, কারো কান্না, কারো চোখে শুধুই উদাসীনতা। কারো চোখে শূন্যতা। এইসব দেখতে দেখতে যখন পুরোনো ঢাকার ধার ঘেষে, আজিমপুর হয়ে মূল শহরে প্রবেশ করি, তখন নিজেকে এই শহরে অনাহুত মনে হয়।

Posted in মুক্তগদ্য | Tagged | 27 টি মন্তব্য

নির্নিমেষ নক্ষত্রের পানে …

“কেউ কেউ এমন শেষ দেখেন যেখানে কোনো আশা নেই, আবার কেউ কেউ এমন আশা দেখেন যার কোনো শেষ নেই।” জানি না কথাটা কে বলেছিলেন, তবে ‘হোপলেস এন্ড’ আর ‘এন্ডলেস হোপ’ নিয়ে বিশ্ব বহু আগেই দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে। থাকবে অনন্তকাল। জগতের শত দুর্বিপাক, শত ঝড়ঝাপটার মধ্যেও কেউ কেউ তাই আশায় বসতি করে, আর কেউ কেউ দুর্ভাগ্যকে গালমন্দ করেই সময় কাটায়, সর্ষের মধ্যে দেখে হাজার হাজার ভূত।

গিল স্টার্ন-এর একটা মন্তব্য মনে পড়ছে: “আমাদের সমাজে আশাবাদী আর হতাশাবাদী উভয়েরই অবদান আছে, আশাবাদী বিমান বানায় আর হতাশাবাদী প্যারাশুট বানায়!” স্বীকার করি, চারপাশে অনপনেয় অন্ধকার, দিগন্তব্যাপী দুঃসময় আর বাধার বিন্ধ্যাচল দেখতে দেখতে কেবল আশা নামের হলুদ পাখিটার ভরসায় বেঁচে থাকা বড় কঠিন। তবু এওতো ঠিক, নিয়তির কাছে অসহায় আত্মসমর্পণের প্রবল পরাক্রান্ত মুহূর্তটিতে আশা ছাড়া আর কোনো সঙ্গীর কথা কি ভাবা যায়? নাকি সঙ্গী পাওয়া যায়? তাইতো হতাশায় খিন্ন হতে হতে, দীর্ণ হতে হতে, শেষমেষ আশাকেই ত্রাতা মানতে হয় সবার।এজন্যই বোধহয় পথ হারানো পথিকের মত জীবনের ছায়াপথে আশাকে খুঁজতে খুঁজতেই সময় কাটে আমাদের। কে না খোঁজে আশাকে? ডাক্তার যাকে জবাব দিয়ে দিয়েছেন, ‘অসম্ভব অসুখ’ থেকে যার আর কোনো উদ্ধার নেই, মৃত্যুকে বরণ করাই যার নিয়তি, সামান্য একটু সান্ত্বনার বাণী শুনলে তারওতো চোখদুটো চকচক করে উঠে, চেহারাটা একটু হলেও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আশা! কলকাতার ফুটপাথে হাঁটতে হাঁটতে, নিজের রক্তে অনন্ত বিসারিত ট্রাম লাইনের বিষাক্ত ছোঁয়া অনুভব করতে করতে, নরম বৃষ্টির হিমস্পর্শে কাঁপতে কাঁপতে জীবনানন্দও ভাবছিলেন দূরের সবুজ প্রান্তর, নদী আর জোনাকির কথা। ভাবছিলেন – আকাশের তারাগুলো সব হারিয়ে গেল নাকি? আশা!

জন ক্লেয়ারের কবিতা মনে পড়ে: এমনকি যে ছোট ভায়োলেট ফুল, সেও অপেক্ষায় থাকে আগামী বসন্তে নতুন করে কুঁড়ি ফোটানোর; আর মানুষ – সে নিশ্চয়ই ভায়োলেটের চাইতেও নগণ্য নয়? দ্বিতীয় একটি বসন্ত পাওয়ার অধিকার তো আছে তারও।” আশা! টেরি ফক্সের কথা মনে পড়ে। ক্যান্সারের সংক্রমণে এক পা হারানোর পরও ক্যান্সারের বিরুদ্ধে মানুষকে জাগানোর সংকল্প নিয়ে মাত্র এক পায়ে কানাডার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দৌড়াতে শুরু করেছিলেন ফক্স। সাড়ে তিন হাজার মাইল দৌড়ানোর পর আর পারেননি, আলিঙ্গন করতে বাধ্য হয়েছিলেন মৃত্যুকে। ফক্স জানতেন কী পরিণতি হবে তাঁর, তবু হাল ছাড়েননি। বিশ্বখ্যাত তাঁর সেই দৌড়ের নাম দিয়েছিলেন ‘ম্যারাথন অব হোপ’। আশা!

১৯৬৩-র ২৮ আগস্ট ওয়াশিংটন ডিসি-র লিংকন মেমোরিয়ালের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দুই লক্ষ মানুষের উদ্দেশে ইতিহাসখ্যাত সেই ‘আমার একটি স্বপ্ন আছে’ বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন বর্ণবৈষম্য মুক্তি আন্দোলনের মহানায়ক মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র। আর কি সেই বক্তৃতা, এককটি শব্দ তো নয়, যেন একেকটি কবিতা, একেকটি নীল অপরাজিতা। ‘আমার একটি স্বপ্ন আছে। আমার ছোট ছোট চারটি ছেলেমেয়ে একদিন এমন এক দেশে বাস করবে যেখানে গায়ের চামড়ার রঙ দিয়ে নয়, চরিত্রের শক্তি দিয়ে বিচার করা হবে তাদের।’ অথবা ‘আমার একটি স্বপ্ন আছে। একদিন জর্জিয়ার লাল পাহাড় থেকে নেমে এসে সাবেক দাস আর দাসমালিকদের সন্তানরা একই টেবিল ঘিরে একসঙ্গে বসবে যে টেবিলের নাম ভ্রাতৃত্ব।’ অথবা ‘এই আমাদের আশা। এ বিশ্বাস নিয়েই হতাশার পর্বত থেকে আশার পাথরখণ্ড বের করে আনব আমরা। এ বিশ্বাস নিয়েই কোলাহলে পূর্ণ আমাদের এ জাতির মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সুরলহরী তৈরি করব। এ বিশ্বাস নিয়েই আবার একসঙ্গে কাজ করব, একসঙ্গে প্রার্থনা করব, একসঙ্গে যুদ্ধ করব, একসঙ্গে জেলে যাব, একসঙ্গে স্বাধীনতার জন্য বুক চিতিয়ে দাঁড়াব, কারণ আমরা জানি একদিন মুক্ত আমরা হবই।’ মার্টিন লুথার কিং আশা ছাড়েননি বলেই একদিন বারাক ওবামা নামের কৃষ্ণসন্তান যুক্তরাষ্ট্রের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হতে পেরেছেন। আপনাদের কি রোসা পার্কসকে মনে আছে? ১৯৫৫-এর একদিন। আলাবামা-র মন্টগোমারি শহরের একটি বাসে করে যাচ্ছিলেন পার্কস। এমন সময় একজন যাত্রী উঠলেন যার গাত্রবর্ণ সাদা, ড্রাইভার কৃষ্ণাঙ্গিনী পার্কসকে নির্দেশ দিল সিট ছেড়ে সাদা মানুষকে বসতে দেয়ার জন্য। এর আগে কোনো কৃষ্ণাঙ্গ যে সাহস দেখায়নি সে সাহসই দেখালেন পার্কস। সোজা বলে দিলেন: আমি উঠবো না। সেদিন থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার আন্দোলন গতি পেল। মার্টিন লুথার কিং আবির্ভুত হলেন কৃষ্ণাঙ্গদের সম অধিকারের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে। লক্ষ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটলেন ওয়াশিংটন ডিসির রাজপথে। মানুষের মুক্তির দাবিতে। ২০০৯ সালে ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবার পর সেদেশের কালো মানুষদের মোবাইল ফোনে একটা মেসেজ দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়েছিল, মেসেজটি ছিল এরকম: ”Rosa sat so that Martin could walk. Martin walked so that Barack could run. Barack ran so that our children could fly”। রোসা বসেছিল যাতে মার্টিন হাঁটতে পারে, মার্টিন হেঁটেছিল যাতে বারাক দৌড়াতে পারে, আর বারাক দৌড়েছিল যাতে আমাদের সন্তানরা উড়তে পারে। উড়বে, সাদা মানুষ কালো মানুষ নির্বিশেষে আমাদের সবার সন্তানই একদিন মুক্তির আকাশে উড়বে, কারণ শেষ বিচারে তারা যে সব অমৃতের সন্তান! কথায় আছে, মানুষ তার আশার সমান বড়। লিওনার্ড লুই লেভিনসন বলেছিলেন, ‘হতাশাবাদী কেবল মেঘের কালো অংশটাই দেখে আর হতাশায় মাথা নাড়ে, দার্শনিক উভয় অংশই দেখেন আর উদাসভাবে কাঁধ ঝাকান, আর আশাবাদী কোনো মেঘই দেখেন না, কারণ তিনিতো মেঘের ওপর দিয়ে হাঁটছেন!’

চারপাশে তাই যখন তুমুল তমিস্রা ঘিরে ধরছে আমাদের, মনে হচ্ছে অনন্ত অন্ধকারের কবল থেকে বাঁচার উপায় নেই কারও, তখনও পৃথিবীর শেষ আশাবাদী মানুষদের মত আশাকেই ভরসা করতে ইচ্ছে করে। অস্কার ওয়াইল্ড-এর বরাভয় কানে আসে: ‘আমরা সবাই পড়ে আছি নর্দমায়, তবু আমাদেরই মধ্যে কারো কারো চোখ নক্ষত্রের দিকে!’

আসুন কণ্টকমুকুট মাথায় দিয়েও আমরা সবাই নির্নিমেষ নক্ষত্রের দিকেই তাকাই। আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে সব দুঃখকে হেলায় জয় করি!

Posted in মুক্তগদ্য | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ডায়েরি

কোন এক বিখ্যাত লেখক বলেছিলেন, ‘তুমি তোমার জীবনটাকে এমনভাবে যাপন করো যেন তোমার ডায়েরি লুকোতে না হয়’। একটা বয়স পর্যন্ত এ কথাটিকে খুব দামী মনে হতো; এখন, যখন সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাই, বুঝতে আর অনেককিছুই ঠিকঠাকভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারি তখন কথাটিকে হালকা মনে হয়। এমন কি কোন ছক রয়েছে যেখানে আঁকা রয়েছে জীবনযাপনের যাবতীয় প্রণালী! জীবনের এমন কোন স্কেল রয়েছে, যে মাত্রায় শুলে-খেলে-পরলে একে যথাযথ বলা যাবে! কোন কর্তৃপক্ষ আমাকে সার্টিফিকেট দেবে? হ্যাঁ তুমি তোমার জীবনটাকে সুন্দর যাপন করেছ- এই নাও পুরস্কার! তার প্রযোজনইবা কি! আসলে ’বিবেক’ নামের গুপ্তশিক্ষক সারাক্ষণ ঘাড়ের কাছে জাইল্যা বেত নিয়ে বসে থাকে বলেই যা অকর্তব্য তা আমরা করি না। আর কিছু নয়। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় তাঁর ৩১ বছরের ডায়েরি রেখে ধরাধাম ত্যাগ করেন। সেই ডায়েরি পড়ার অভিজ্ঞতা নিয়েই লিখতে বসা।

আমার বাবাও ডায়েরি লিখেন। তিনিও লেখক। তাঁর লেখা ডায়েরিও আমি পড়েছি (অনুমতি নিয়ে)। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে এই দুইজায়গায় তাঁর মিল রয়েছে; অমিলের জায়গা হলো সন্দিপন চট্টোপাধ্যায় ডায়েরি লিখতে আড়াল নেননি, আমার পিতা শতভাগই নিয়েছেন। তাই ঠিক একই সময়ের; সন্দীপনের জন্ম ১৯৩৩ আমার পিতার ১৯৩৯ দু’জন লেখকের (দাবী করবোনা আমার পিতা বড় কোন লেখক, তবে আমার কাছে তিনি বড়ই) ডায়েরি ঠিক দু’রকম। সন্দীপনের ডায়েরি নিয়ে লিখতে বসে পিতার প্রসঙ্গ টানার কারণ একটিই, আমার পিতা ব্যক্তিগত জীবন পুরোটিই আড়াল করে ডায়েরি লিখেছেন, তাই তাঁর ডায়েরি পড়ে কেবল একটি রেফারেন্স বুকের উপকার পাই, তাতে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির ইতিহাস ঝালাই হয় বটে, সন্দীপনের মতো জীবনের গুঢ় অর্থ বুঝতে সাহায্য করার জন্য এবং তার নির্লিপ্ত মূল্যায়ণ করতে একটি তৃতীয় চক্ষুর জন্ম আমার হয় না!

সাহিত্যে ভারতের বঙ্কিম পুরস্কার এবং আকাদেমি পুরস্কার প্রাপ্ত লেখক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় গল্প লিখেছেন ৭০টি, উপন্যাস ২১টি এবং লিখেছেন অসংখ্য নিবন্ধ। একইসাথে লিখেছেন এই ডায়েরিটি, যেটি তাঁর মৃত্যর পর বেরিয়েছে, নাম ’সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ডায়েরি’। বই এর ব্যাক কভারে লেখা হয়েছে,

’দুঃসাহসী, অকপট, আনপ্রেডিক্টেবল। যা মনে করেছেন তাই লিখেছেন। গোটা বাংলা লেখালেখির জগৎকে ফালাফালা করেছেন। এমনকি বাদ যায়নি নিজেও। শুধু বিতর্কিত নয়, একই সঙ্গে গভীর, মননশীল, বুদ্ধিদীপ্ত। এই আনসেনসেরড ও আনএডিটেড সন্দীপন গুছিয়ে দেওয়া হল টীকাটিপ্পনীসহ।’

সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় তো লিখে ভয়ঙ্কর কান্ড ঘটিয়েছেন, পাঠক পড়ে তুমুল জ্ঞান লাভ করেছে কিন্তু সেসব নিয়ে রিভিউ করতে বসে মহাবিপদে পড়েছি। এত সেন্সর করে রিভিউ লিখলে তো ঠকানো কাজ হয়। তবু চেপেচুপে লিখতে চেষ্টা করছি।

ডায়েরি বলতে নিছক দিনযাপন আর রোজকার যে গল্প আমরা পড়ি তার অতিরিক্ত অনেক বিষয় সন্দীপন লিখে রেখে গেছেন। আধুনিক জীবনযাপন পাল্টে গেছে, জীবনযাপনের যেসব ’অনিয়ম’ নজরে পড়ে; আমরা দেখি-পড়ি কিন্তু স্বীকৃতি দেই না। ব্রাহ্মনসুলভ ভাষায় ছ্যা ছ্যা করি। সন্দীপন যখন বলেন, রোজিটার সঙ্গে প্রথম নগ্ন রাত্রিবাসের সময় বারবার বলছিলুমbut nothing is happening-nothing happens, তখন হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে কারণ বর্ণনা সেখানেই থেমে ছিল না, অনেক কথাই লিখে ফেলেছেন তিনি, সেই প্রসঙ্গ ধরেই! না রোজিটা তাঁর স্ত্রী নন- বান্ধবী।

মনস্তত্ত্ব যে সন্দীপনের ডায়েরির মূল ভিত্তি তার প্রমান রয়েছে অসংখ্য। অবদমিত বাসনার প্রকাশে সন্দীপন শুধু পারঙ্গমই নন তার লিপিবদ্ধ করণেও তিনি অকপট। সন্দীপনের পক্ষেই লেখা সম্ভব, একদিন মেট্টোয় গিরিশ পার্কে নেমে সাইসাই সেন্ট্রাল এভিন্যুতে দাঁড়িয়ে ভাবছি, ডানদিকে গেলে আজকাল, বা দিকে সোনাগাছি, কোথায় যাবো?

কিংবা,

আমি ব্যর্থ! ১) যৌন জীবনে। এটা ধ্বংস করা হয়েছে। এবং করতে দিয়েছি চোখের সামনে। আজ পুনরুজ্জীবনের আশা নেই-সুযোগ এলেও। ২) কেরিয়ার তৈরির ব্যাপারে। সম্পূর্ণ ব্যর্থ। কারণ এ সম্পর্কে প্রলব্ধ শিক্ষা ছিল না যে কীভাবে করতে হয়- যেভাবে করতে দেখলুম অনেককে। সবচেয়ে সহজ ছিল কিন্তু এই ব্যাপারটাই। আমার পক্ষে। ৩) লেখক হিসেবে। এটা অবশ্য নিজেই পন্ড করেছি… নিজেকে কিছু দিতে পারি নি-লেখককে কেন দেব?

সন্দীপন অসাধারণ হেলাফেলায় তাঁর ডায়েরি লিখেছেন, অথচ গভীরে প্রবেশ করলে দেখা যায় অসামান্য যত্ন তাঁর লেখায় পরতে পরতে, সন্দীপনের বলা একটি কথাকেও হেলাফেলা করা যায় না, ফেলে দেয়া যাবে না, অহেতুক বলা যাবে না। ডায়েরিতে লেখা একটি বাক্য হাতে নিয়ে-ও সারারাত বসে থাকা যায়। তেমন ‘একটি বাক্য’ অসংখ্য। কয়েকটি উদাহরণ দেই…

২১ ডিসেম্বর ১৯৯৩ তে লিখেছেন, ঘুম থেকে উঠে ক্লান্ত লাগে এত। মিকি মাউসের কার্টুনে মিকির ওপর দিয়ে একটা রোলার চলে গেছে যেন। কাগজ হয়ে গেছি। ফুলে-ফেঁপে আবার মাউস হই। কী হল আমার?

তারিখ নেই, ১) বলো, কখন, ২) কাল শেষ দিন, ৩) এসো, বমি করি

১১ মার্চ ২০০০, গল্পলেখকের দায়বদ্ধতা হল গল্পের ক্ষতস্থানটি ব্যান্ডেজ খুলে পাঠককে দেখানো। একই দায়বদ্ধতা কবির। চিত্রশিল্পীর। এবং গায়কের।

সন্দীপন চলে গেছেন ২০০৫ এ। তাঁর ডায়েরির প্রথমপাতা ১৯৭১ এর আগস্ট। ১৯৭৪ সালে তিনি লিখেছেন, প্রতিদিন ভোরে বেঁচে আছি দেখে অবাক হই। পুরো ডায়েরির কোথাও কোথাও এভাবে মৃত্যুচিন্তা এসেছে, এসেছে হেলাফেলায়, এসেছে ভয়ে এবং দুশ্চিন্তায়।

সন্দীপনের ডায়েরির আরেকটি দিক তাঁর লেখালেখির,গল্প-উপন্যাসের খসড়া এতে লিখে রেখেছেন। প্লট-চরিত্র নিয়ে ছোট ছোট কথা রয়েছে। রয়েছে প্ল্যানিং। বৃষ্টির পরে কি হয়, তা নিয়ে দুটো দৃশ্য রয়েছে,

একটি, দৃশ্য-২ নামে রয়েছে এমন, নিশ্চল রিক্সার ওপর ওৎপেতে সরু ও জ্যান্ত চোখ মুখ থেকে মুখ সরিয়ে সওয়ারি খুঁজছে কিশোর বালক

কিছু খুব গভীর আর দার্শনিক কথা রয়েছে। যেমন,

১) ঘুম মানুষের অচেতন নগ্নতা, সচেতন নগ্নতা হল, যখন ডাক্তার দেখে। বিশেষত গায়নোকোলোজিস্ট।
২) আনন্দ একটা জটিল আবেগ, শোকও তাই।
৩) আবেগসমূহের মধ্যে ভয়, আহ্লাদ, ক্রোধ এগুলোর মধ্যে জটিলতা নেই। এগুলো সরল প্রকৃতির।
৪) শুধু মানুষ মরণশীল নয় তা তো নয়- সম্পর্কও মরণশীল।
৫) আমি ভালোবাসায় বিশ্বাস করি। যেখানে ভালোবাসা নেই, আমি সেই অবস্থান স্বীকার করি না।
৬) লেখক কোন অভিজ্ঞতার ভিতরে থেকে লিখতে পারে না। সে বেরিয়ে আসে অভিজ্ঞতা থেকে বা অভিজ্ঞতাই তাকে অভিজ্ঞতার বাইরে ঠেলে দেয়।
৭) বড় হবার পর প্রত্যেক মানুষের অধিকার আছে পরের দেওয়া নাম গ্রহন অথবা বর্জন করে নিজে নাম রাখার। এ তার মৌলিক অধিকার।
৮) জীবনে বাংলা ডিক্সনারি দেখিনি। খুলিনি। শ্রেষ্ঠ বাংলা ভাষা জানি। জীবনে একটা নারী নেই। শ্রেষ্ঠ যৌনমনা। একটা কলম পেলাম না যার মন আছে।
৯) এখন বেলচার মত কলমের পেছনটা ধরে ঠেলছি। হ্যাঁ, এটা কোদালই। কলম নয় কিছুতেই।

হুমায়ূন আজাদকে প্রথাহীন লেখক বলা হয়, সন্দীপনের সাথে বিশেষনটা খুব যায়। সন্দীপন সমালোচনায় একেবারে জোরালো। লুকোনো কথা বাইরে বের করে এনছেন। ডায়েরিতে লিখেছেন,
সে অনেক দিন হল ঋত্বিক ঘটক বলেছিল, গান্ধিজী একটি আদ্যন্ত শুয়োরের বাচ্চা। প্রতি বিদেশপ্রত্যাগতর পর অনুরূপ একটি নাউন বসে এবং তা হল- খচ্চর। আরেক জায়গায় লিখেছেন, আমাদের মধ্যে হঠকারি ছিল শক্তি আর শ্যামল (শক্তি চট্টোপাধ্যায় আর শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়!)।

সন্দীপনের গভীর জীবনবোধ, জীবনকে কৌতুকভরে দেখার চেতনা বা দার্শনিকতা- জীবনের নিবিড় ঘনিষ্ঠতা থেকেই এসেছে। সন্দীপনের ডায়েরি তাই অন্তর উন্মোচনের কাজটি করতে যায়। পারে, কী পারে না তার মূল্যায়ণ পরে, কিন্তু গভীরতার দর্শন লাভ অগুরুত্বপূর্ণ নয় মোটেই।

সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৩ সালের অক্টোবরে এবং মৃত্যু ২০০৫ এর ডিসেম্বরে। অন্যদিকে ডায়েরির শুরু ১৯৭১ এর অগাস্ট আর শেষ ২০০৫ এর ডিসেম্বরে। মাঝে বাদ দিয়ে একত্রিশ বছর ধরে তিনি ডায়েরি লিখেছেন। পাঠক হয়ে ’সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ডায়েরি’র ৩১ টি বছরের সাথে সাথে চলি। ভিষণ আমুদে, চঞ্চল, বেহিসেবি, তুখোড় রসিক, মেধাবি, সংবেদনশীল একজন মানুষের জীবনের অনুপুঙ্খ জানতে জানতে ২০০৪-২০০৫ এ ক্যান্সার আক্রান্ত সন্দীপনের জন্য গভীর দুঃখ টের পাই। আস্তে আস্তে মৃত্যু এগিয়ে আসছে। রে দিচ্ছেন, অপারেশন হচ্ছে, টিউমার কাটছে… ২০০৫ এর ৬ ডিসেম্বর শেষ ডায়েরি লিখেছেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। আমরা জানি, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় পৃথিবী থেকে চলে গেছেন ২০০৫ এর ১২ ডিসেম্বর!

Posted in রিভিউ | Tagged , , | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

পটচিত্র

প্রাচীন কিন্তু উজ্জ্বল একজন বৃদ্ধের সাথে তর্ক করছেন একজন অতি সুদর্শন তরুণ। বৃদ্ধ খানিক আগেই স্নান সেরেছে; শরীর থেকে এখনো পুরোপুরি মুছে যায়নি জলের ঘ্রাণ। গোধুলীময় সন্ধ্যার ডাকে চিঠি এসেছে স্বর্গ থেকে; বৃদ্ধ ইষৎ উৎফুল্ল-তর্কপ্রিয় গ্রীবা বাড়িয়ে রেখেছে সামনে। আর আমাদের সুদর্শন তরুণ… একটা আলোয়ান গায়ে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন বৃদ্ধের মুখোমুখি। তাদের ধারাবাহিক, সূদীর্ঘ বিতর্ক উদ্দাম নদীর মতো বয়ে চলেছিল সন্ধ্যার সমান্তরালে।

হিমধরানো শীতের বিকেল…

দূর্গম গুহার মধ্যে চোখ মুঁদে বসে আছেন সর্বজ্ঞানী বৃদ্ধ। একটা বাঁচাল ইঁদুর লেজের ডগায় মশাল বেঁধে ডিগবাজী খাচ্ছিল। তরুণ ইঁদুরদের ধারাবাহিক কলরোলে বিরক্ত, চোখ মেলে তাঁকিয়ে বললেন-দুর হও শয়তানের অনুচরেরা। ইঁদুররা পালিয়ে বাঁচলো। বৃদ্ধ কপাল কুঁচকে বললো- হে বালক! জানো নাকি- ডুবন্ত পিঁপড়ার কাছে গরম খাদ্যের চেয়েও দামী মনে হয় একটি শুষ্ক গাছের পাতা! তরুণ চিন্তিত হয়ে বললো, তাই! জানি নাতো!

পৃথিবীর পুরনো খোঁড়ল, বৃষ্টিময় একটি দুপুর

দুটো দুষ্টুমিষ্টি পাখি হাত ধরাধরি করে বসে আছে একটি বৃক্ষের ফসিলের ওপর। পাখি দুটো নিজেদের মধ্যে কথা বলছে অদ্ভুৎ এক ভাষায়। একটা পাখি পুরুষ, অন্যটি মহিলা। পুরুষ পাখিটি বললো, শুনেছো, মানুষ নাকি আগুনে এক নল বানিয়েছে, বোতামে চাপ দিলে বেরিয়ে আসে কমলা আগুন। মেয়ে পাখিটি বললো-শুনেছি। মানুষ নাকি একটি ডিম বানিয়েছে, যেটি বিস্ফোরিত হয়, ধ্বংস করে জনপদ, রূদ্ধ করে স্রোতস্বিনীর গতি। মেয়ে পাখি বললো-শুনেছি। শুনেছো, মানুষ নাকি নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করছে, মরে যাচ্ছে হাজার হাজার।

শুনেছি।

শুনেছো, মানুষ নাকি জয় করেছে আকাশ এবং পাতাল। ওরা নাকি পৌঁছে যাবে চাঁদের কাছেও।

শুনেছি, হাই তুললো মেয়ে পাখিটি।

বৃদ্ধ আর তরুণ মেয়ে আর ছেলে পাখির গল্পগুজব শুনে মুগ্ধ হলো। তারা আরো এগিয়ে গেল…

অনেকবছর পর...

উদিত সূর্যকে সামনে রেখে গল্প করে চলছে সেই বৃদ্ধ আর সুদর্শন তরুণ… বৃদ্ধের লোমচর্ম শরীর হয়ে গেছে আরো ক্ষীণকায়, তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে, ধুলিসিক্ত-ছিন্নভিন্ন আলোয়ানটার বয়েস যেন বেড়ে গিয়েছে আরো একলক্ষ বছর। চারপাশের পাখিগুলো কোথায় চলে গেছে… গাছের পাতা ঝরতে ঝরতে কঙ্কালসার হয়ে গিয়েছে। গাছের শেকড়গুলোতে আক্রমণ করেছে গভীর গোপন কোনো রোগ। তাদের গল্প চলছে। বৃদ্ধ, তরুণ দুজনেই ক্লান্ত।

কুয়াশাঘেরা একটি প্রান্তর, নিস্তব্ধ রাত্রি

উড়তে উড়তে ক্লান্ত হয়ে মাটিতে নামলো দুটো বাজপাখি, একটি বাদুড় আর একটি মিষ্টি চেহারার কোকিল। রাতটা ছিলো বুনো, বাতাস ছিলো ভেজা, আকাশ ছিলো বেগুনি দূর্বোধ্যতায় মোড়া। একটা বাজপাখি; ঝুলে গিয়েছে যার চোয়াল। দিগন্তে তাকিয়ে বললো-এই মহাপ্রকৃতির কি মূল্য! আকাশ নেমে আসুক পৃথিবীর ধূলোয়, মেঘগুলো বিস্ফোরিত হোক বন্য চিৎকারে।

আচমকা মিষ্টি গলায় গান গেয়ে উঠলো কোকিল পাখিটা…

শেষ…

সূর্য অস্ত যাচ্ছে ধীরগাম্ভীর্যে, পাখিগুলো ফিরে যাচ্ছে নীড়ে, চাপা গর্জনে বয়ে যাচ্ছে মৃত্যুনীল মহাসমুদ্র । মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এখনো গল্প করছে বৃদ্ধ এবং সুদর্শন তরুণ। বৃদ্ধের ঘোলাটে দৃষ্টি নির্মীলিত মহাদিগন্তে, বৃদ্ধ দেখছেন পাহাড়ের চূড়ায় নিবিড় অন্ধকার। ধীর, শান্ত এবং সুতীক্ষ্ণ কন্ঠে ওরা রচনা করে যাচ্ছে যুক্তির বিস্তীর্ণ জাল।

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বৃদ্ধ পন্ডিতের এবং তরুণের তর্ক চলছিলো…

Posted in মুক্তগদ্য | Tagged | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান