পটচিত্র

প্রাচীন কিন্তু উজ্জ্বল একজন বৃদ্ধের সাথে তর্ক করছেন একজন অতি সুদর্শন তরুণ। বৃদ্ধ খানিক আগেই স্নান সেরেছে; শরীর থেকে এখনো পুরোপুরি মুছে যায়নি জলের ঘ্রাণ। গোধুলীময় সন্ধ্যার ডাকে চিঠি এসেছে স্বর্গ থেকে; বৃদ্ধ ইষৎ উৎফুল্ল-তর্কপ্রিয় গ্রীবা বাড়িয়ে রেখেছে সামনে। আর আমাদের সুদর্শন তরুণ… একটা আলোয়ান গায়ে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন বৃদ্ধের মুখোমুখি। তাদের ধারাবাহিক, সূদীর্ঘ বিতর্ক উদ্দাম নদীর মতো বয়ে চলেছিল সন্ধ্যার সমান্তরালে।

হিমধরানো শীতের বিকেল…

দূর্গম গুহার মধ্যে চোখ মুঁদে বসে আছেন সর্বজ্ঞানী বৃদ্ধ। একটা বাঁচাল ইঁদুর লেজের ডগায় মশাল বেঁধে ডিগবাজী খাচ্ছিল। তরুণ ইঁদুরদের ধারাবাহিক কলরোলে বিরক্ত, চোখ মেলে তাঁকিয়ে বললেন-দুর হও শয়তানের অনুচরেরা। ইঁদুররা পালিয়ে বাঁচলো। বৃদ্ধ কপাল কুঁচকে বললো- হে বালক! জানো নাকি- ডুবন্ত পিঁপড়ার কাছে গরম খাদ্যের চেয়েও দামী মনে হয় একটি শুষ্ক গাছের পাতা! তরুণ চিন্তিত হয়ে বললো, তাই! জানি নাতো!

পৃথিবীর পুরনো খোঁড়ল, বৃষ্টিময় একটি দুপুর

দুটো দুষ্টুমিষ্টি পাখি হাত ধরাধরি করে বসে আছে একটি বৃক্ষের ফসিলের ওপর। পাখি দুটো নিজেদের মধ্যে কথা বলছে অদ্ভুৎ এক ভাষায়। একটা পাখি পুরুষ, অন্যটি মহিলা। পুরুষ পাখিটি বললো, শুনেছো, মানুষ নাকি আগুনে এক নল বানিয়েছে, বোতামে চাপ দিলে বেরিয়ে আসে কমলা আগুন। মেয়ে পাখিটি বললো-শুনেছি। মানুষ নাকি একটি ডিম বানিয়েছে, যেটি বিস্ফোরিত হয়, ধ্বংস করে জনপদ, রূদ্ধ করে স্রোতস্বিনীর গতি। মেয়ে পাখি বললো-শুনেছি। শুনেছো, মানুষ নাকি নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করছে, মরে যাচ্ছে হাজার হাজার।

শুনেছি।

শুনেছো, মানুষ নাকি জয় করেছে আকাশ এবং পাতাল। ওরা নাকি পৌঁছে যাবে চাঁদের কাছেও।

শুনেছি, হাই তুললো মেয়ে পাখিটি।

বৃদ্ধ আর তরুণ মেয়ে আর ছেলে পাখির গল্পগুজব শুনে মুগ্ধ হলো। তারা আরো এগিয়ে গেল…

অনেকবছর পর...

উদিত সূর্যকে সামনে রেখে গল্প করে চলছে সেই বৃদ্ধ আর সুদর্শন তরুণ… বৃদ্ধের লোমচর্ম শরীর হয়ে গেছে আরো ক্ষীণকায়, তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে, ধুলিসিক্ত-ছিন্নভিন্ন আলোয়ানটার বয়েস যেন বেড়ে গিয়েছে আরো একলক্ষ বছর। চারপাশের পাখিগুলো কোথায় চলে গেছে… গাছের পাতা ঝরতে ঝরতে কঙ্কালসার হয়ে গিয়েছে। গাছের শেকড়গুলোতে আক্রমণ করেছে গভীর গোপন কোনো রোগ। তাদের গল্প চলছে। বৃদ্ধ, তরুণ দুজনেই ক্লান্ত।

কুয়াশাঘেরা একটি প্রান্তর, নিস্তব্ধ রাত্রি

উড়তে উড়তে ক্লান্ত হয়ে মাটিতে নামলো দুটো বাজপাখি, একটি বাদুড় আর একটি মিষ্টি চেহারার কোকিল। রাতটা ছিলো বুনো, বাতাস ছিলো ভেজা, আকাশ ছিলো বেগুনি দূর্বোধ্যতায় মোড়া। একটা বাজপাখি; ঝুলে গিয়েছে যার চোয়াল। দিগন্তে তাকিয়ে বললো-এই মহাপ্রকৃতির কি মূল্য! আকাশ নেমে আসুক পৃথিবীর ধূলোয়, মেঘগুলো বিস্ফোরিত হোক বন্য চিৎকারে।

আচমকা মিষ্টি গলায় গান গেয়ে উঠলো কোকিল পাখিটা…

শেষ…

সূর্য অস্ত যাচ্ছে ধীরগাম্ভীর্যে, পাখিগুলো ফিরে যাচ্ছে নীড়ে, চাপা গর্জনে বয়ে যাচ্ছে মৃত্যুনীল মহাসমুদ্র । মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এখনো গল্প করছে বৃদ্ধ এবং সুদর্শন তরুণ। বৃদ্ধের ঘোলাটে দৃষ্টি নির্মীলিত মহাদিগন্তে, বৃদ্ধ দেখছেন পাহাড়ের চূড়ায় নিবিড় অন্ধকার। ধীর, শান্ত এবং সুতীক্ষ্ণ কন্ঠে ওরা রচনা করে যাচ্ছে যুক্তির বিস্তীর্ণ জাল।

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বৃদ্ধ পন্ডিতের এবং তরুণের তর্ক চলছিলো…

This entry was posted in মুক্তগদ্য and tagged . Bookmark the permalink.

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s