কোন এক বিখ্যাত লেখক বলেছিলেন, ‘তুমি তোমার জীবনটাকে এমনভাবে যাপন করো যেন তোমার ডায়েরি লুকোতে না হয়’। একটা বয়স পর্যন্ত এ কথাটিকে খুব দামী মনে হতো; এখন, যখন সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাই, বুঝতে আর অনেককিছুই ঠিকঠাকভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারি তখন কথাটিকে হালকা মনে হয়। এমন কি কোন ছক রয়েছে যেখানে আঁকা রয়েছে জীবনযাপনের যাবতীয় প্রণালী! জীবনের এমন কোন স্কেল রয়েছে, যে মাত্রায় শুলে-খেলে-পরলে একে যথাযথ বলা যাবে! কোন কর্তৃপক্ষ আমাকে সার্টিফিকেট দেবে? হ্যাঁ তুমি তোমার জীবনটাকে সুন্দর যাপন করেছ- এই নাও পুরস্কার! তার প্রযোজনইবা কি! আসলে ’বিবেক’ নামের গুপ্তশিক্ষক সারাক্ষণ ঘাড়ের কাছে জাইল্যা বেত নিয়ে বসে থাকে বলেই যা অকর্তব্য তা আমরা করি না। আর কিছু নয়। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় তাঁর ৩১ বছরের ডায়েরি রেখে ধরাধাম ত্যাগ করেন। সেই ডায়েরি পড়ার অভিজ্ঞতা নিয়েই লিখতে বসা।
আমার বাবাও ডায়েরি লিখেন। তিনিও লেখক। তাঁর লেখা ডায়েরিও আমি পড়েছি (অনুমতি নিয়ে)। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে এই দুইজায়গায় তাঁর মিল রয়েছে; অমিলের জায়গা হলো সন্দিপন চট্টোপাধ্যায় ডায়েরি লিখতে আড়াল নেননি, আমার পিতা শতভাগই নিয়েছেন। তাই ঠিক একই সময়ের; সন্দীপনের জন্ম ১৯৩৩ আমার পিতার ১৯৩৯ দু’জন লেখকের (দাবী করবোনা আমার পিতা বড় কোন লেখক, তবে আমার কাছে তিনি বড়ই) ডায়েরি ঠিক দু’রকম। সন্দীপনের ডায়েরি নিয়ে লিখতে বসে পিতার প্রসঙ্গ টানার কারণ একটিই, আমার পিতা ব্যক্তিগত জীবন পুরোটিই আড়াল করে ডায়েরি লিখেছেন, তাই তাঁর ডায়েরি পড়ে কেবল একটি রেফারেন্স বুকের উপকার পাই, তাতে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির ইতিহাস ঝালাই হয় বটে, সন্দীপনের মতো জীবনের গুঢ় অর্থ বুঝতে সাহায্য করার জন্য এবং তার নির্লিপ্ত মূল্যায়ণ করতে একটি তৃতীয় চক্ষুর জন্ম আমার হয় না!
সাহিত্যে ভারতের বঙ্কিম পুরস্কার এবং আকাদেমি পুরস্কার প্রাপ্ত লেখক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় গল্প লিখেছেন ৭০টি, উপন্যাস ২১টি এবং লিখেছেন অসংখ্য নিবন্ধ। একইসাথে লিখেছেন এই ডায়েরিটি, যেটি তাঁর মৃত্যর পর বেরিয়েছে, নাম ’সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ডায়েরি’। বই এর ব্যাক কভারে লেখা হয়েছে,
’দুঃসাহসী, অকপট, আনপ্রেডিক্টেবল। যা মনে করেছেন তাই লিখেছেন। গোটা বাংলা লেখালেখির জগৎকে ফালাফালা করেছেন। এমনকি বাদ যায়নি নিজেও। শুধু বিতর্কিত নয়, একই সঙ্গে গভীর, মননশীল, বুদ্ধিদীপ্ত। এই আনসেনসেরড ও আনএডিটেড সন্দীপন গুছিয়ে দেওয়া হল টীকাটিপ্পনীসহ।’
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় তো লিখে ভয়ঙ্কর কান্ড ঘটিয়েছেন, পাঠক পড়ে তুমুল জ্ঞান লাভ করেছে কিন্তু সেসব নিয়ে রিভিউ করতে বসে মহাবিপদে পড়েছি। এত সেন্সর করে রিভিউ লিখলে তো ঠকানো কাজ হয়। তবু চেপেচুপে লিখতে চেষ্টা করছি।
ডায়েরি বলতে নিছক দিনযাপন আর রোজকার যে গল্প আমরা পড়ি তার অতিরিক্ত অনেক বিষয় সন্দীপন লিখে রেখে গেছেন। আধুনিক জীবনযাপন পাল্টে গেছে, জীবনযাপনের যেসব ’অনিয়ম’ নজরে পড়ে; আমরা দেখি-পড়ি কিন্তু স্বীকৃতি দেই না। ব্রাহ্মনসুলভ ভাষায় ছ্যা ছ্যা করি। সন্দীপন যখন বলেন, রোজিটার সঙ্গে প্রথম নগ্ন রাত্রিবাসের সময় বারবার বলছিলুম, but nothing is happening-nothing happens, তখন হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে কারণ বর্ণনা সেখানেই থেমে ছিল না, অনেক কথাই লিখে ফেলেছেন তিনি, সেই প্রসঙ্গ ধরেই! না রোজিটা তাঁর স্ত্রী নন- বান্ধবী।
মনস্তত্ত্ব যে সন্দীপনের ডায়েরির মূল ভিত্তি তার প্রমান রয়েছে অসংখ্য। অবদমিত বাসনার প্রকাশে সন্দীপন শুধু পারঙ্গমই নন তার লিপিবদ্ধ করণেও তিনি অকপট। সন্দীপনের পক্ষেই লেখা সম্ভব, একদিন মেট্টোয় গিরিশ পার্কে নেমে সাইসাই সেন্ট্রাল এভিন্যুতে দাঁড়িয়ে ভাবছি, ডানদিকে গেলে আজকাল, বা দিকে সোনাগাছি, কোথায় যাবো?
কিংবা,
আমি ব্যর্থ! ১) যৌন জীবনে। এটা ধ্বংস করা হয়েছে। এবং করতে দিয়েছি চোখের সামনে। আজ পুনরুজ্জীবনের আশা নেই-সুযোগ এলেও। ২) কেরিয়ার তৈরির ব্যাপারে। সম্পূর্ণ ব্যর্থ। কারণ এ সম্পর্কে প্রলব্ধ শিক্ষা ছিল না যে কীভাবে করতে হয়- যেভাবে করতে দেখলুম অনেককে। সবচেয়ে সহজ ছিল কিন্তু এই ব্যাপারটাই। আমার পক্ষে। ৩) লেখক হিসেবে। এটা অবশ্য নিজেই পন্ড করেছি… নিজেকে কিছু দিতে পারি নি-লেখককে কেন দেব?
সন্দীপন অসাধারণ হেলাফেলায় তাঁর ডায়েরি লিখেছেন, অথচ গভীরে প্রবেশ করলে দেখা যায় অসামান্য যত্ন তাঁর লেখায় পরতে পরতে, সন্দীপনের বলা একটি কথাকেও হেলাফেলা করা যায় না, ফেলে দেয়া যাবে না, অহেতুক বলা যাবে না। ডায়েরিতে লেখা একটি বাক্য হাতে নিয়ে-ও সারারাত বসে থাকা যায়। তেমন ‘একটি বাক্য’ অসংখ্য। কয়েকটি উদাহরণ দেই…
২১ ডিসেম্বর ১৯৯৩ তে লিখেছেন, ঘুম থেকে উঠে ক্লান্ত লাগে এত। মিকি মাউসের কার্টুনে মিকির ওপর দিয়ে একটা রোলার চলে গেছে যেন। কাগজ হয়ে গেছি। ফুলে-ফেঁপে আবার মাউস হই। কী হল আমার?
তারিখ নেই, ১) বলো, কখন, ২) কাল শেষ দিন, ৩) এসো, বমি করি
১১ মার্চ ২০০০, গল্পলেখকের দায়বদ্ধতা হল গল্পের ক্ষতস্থানটি ব্যান্ডেজ খুলে পাঠককে দেখানো। একই দায়বদ্ধতা কবির। চিত্রশিল্পীর। এবং গায়কের।
সন্দীপন চলে গেছেন ২০০৫ এ। তাঁর ডায়েরির প্রথমপাতা ১৯৭১ এর আগস্ট। ১৯৭৪ সালে তিনি লিখেছেন, প্রতিদিন ভোরে বেঁচে আছি দেখে অবাক হই। পুরো ডায়েরির কোথাও কোথাও এভাবে মৃত্যুচিন্তা এসেছে, এসেছে হেলাফেলায়, এসেছে ভয়ে এবং দুশ্চিন্তায়।
সন্দীপনের ডায়েরির আরেকটি দিক তাঁর লেখালেখির,গল্প-উপন্যাসের খসড়া এতে লিখে রেখেছেন। প্লট-চরিত্র নিয়ে ছোট ছোট কথা রয়েছে। রয়েছে প্ল্যানিং। বৃষ্টির পরে কি হয়, তা নিয়ে দুটো দৃশ্য রয়েছে,
একটি, দৃশ্য-২ নামে রয়েছে এমন, নিশ্চল রিক্সার ওপর ওৎপেতে সরু ও জ্যান্ত চোখ মুখ থেকে মুখ সরিয়ে সওয়ারি খুঁজছে কিশোর বালক।
কিছু খুব গভীর আর দার্শনিক কথা রয়েছে। যেমন,
১) ঘুম মানুষের অচেতন নগ্নতা, সচেতন নগ্নতা হল, যখন ডাক্তার দেখে। বিশেষত গায়নোকোলোজিস্ট।
২) আনন্দ একটা জটিল আবেগ, শোকও তাই।
৩) আবেগসমূহের মধ্যে ভয়, আহ্লাদ, ক্রোধ এগুলোর মধ্যে জটিলতা নেই। এগুলো সরল প্রকৃতির।
৪) শুধু মানুষ মরণশীল নয় তা তো নয়- সম্পর্কও মরণশীল।
৫) আমি ভালোবাসায় বিশ্বাস করি। যেখানে ভালোবাসা নেই, আমি সেই অবস্থান স্বীকার করি না।
৬) লেখক কোন অভিজ্ঞতার ভিতরে থেকে লিখতে পারে না। সে বেরিয়ে আসে অভিজ্ঞতা থেকে বা অভিজ্ঞতাই তাকে অভিজ্ঞতার বাইরে ঠেলে দেয়।
৭) বড় হবার পর প্রত্যেক মানুষের অধিকার আছে পরের দেওয়া নাম গ্রহন অথবা বর্জন করে নিজে নাম রাখার। এ তার মৌলিক অধিকার।
৮) জীবনে বাংলা ডিক্সনারি দেখিনি। খুলিনি। শ্রেষ্ঠ বাংলা ভাষা জানি। জীবনে একটা নারী নেই। শ্রেষ্ঠ যৌনমনা। একটা কলম পেলাম না যার মন আছে।
৯) এখন বেলচার মত কলমের পেছনটা ধরে ঠেলছি। হ্যাঁ, এটা কোদালই। কলম নয় কিছুতেই।
হুমায়ূন আজাদকে প্রথাহীন লেখক বলা হয়, সন্দীপনের সাথে বিশেষনটা খুব যায়। সন্দীপন সমালোচনায় একেবারে জোরালো। লুকোনো কথা বাইরে বের করে এনছেন। ডায়েরিতে লিখেছেন,
সে অনেক দিন হল ঋত্বিক ঘটক বলেছিল, গান্ধিজী একটি আদ্যন্ত শুয়োরের বাচ্চা। প্রতি বিদেশপ্রত্যাগতর পর অনুরূপ একটি নাউন বসে এবং তা হল- খচ্চর। আরেক জায়গায় লিখেছেন, আমাদের মধ্যে হঠকারি ছিল শক্তি আর শ্যামল (শক্তি চট্টোপাধ্যায় আর শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়!)।
সন্দীপনের গভীর জীবনবোধ, জীবনকে কৌতুকভরে দেখার চেতনা বা দার্শনিকতা- জীবনের নিবিড় ঘনিষ্ঠতা থেকেই এসেছে। সন্দীপনের ডায়েরি তাই অন্তর উন্মোচনের কাজটি করতে যায়। পারে, কী পারে না তার মূল্যায়ণ পরে, কিন্তু গভীরতার দর্শন লাভ অগুরুত্বপূর্ণ নয় মোটেই।
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৩ সালের অক্টোবরে এবং মৃত্যু ২০০৫ এর ডিসেম্বরে। অন্যদিকে ডায়েরির শুরু ১৯৭১ এর অগাস্ট আর শেষ ২০০৫ এর ডিসেম্বরে। মাঝে বাদ দিয়ে একত্রিশ বছর ধরে তিনি ডায়েরি লিখেছেন। পাঠক হয়ে ’সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ডায়েরি’র ৩১ টি বছরের সাথে সাথে চলি। ভিষণ আমুদে, চঞ্চল, বেহিসেবি, তুখোড় রসিক, মেধাবি, সংবেদনশীল একজন মানুষের জীবনের অনুপুঙ্খ জানতে জানতে ২০০৪-২০০৫ এ ক্যান্সার আক্রান্ত সন্দীপনের জন্য গভীর দুঃখ টের পাই। আস্তে আস্তে মৃত্যু এগিয়ে আসছে। রে দিচ্ছেন, অপারেশন হচ্ছে, টিউমার কাটছে… ২০০৫ এর ৬ ডিসেম্বর শেষ ডায়েরি লিখেছেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। আমরা জানি, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় পৃথিবী থেকে চলে গেছেন ২০০৫ এর ১২ ডিসেম্বর!