নির্নিমেষ নক্ষত্রের পানে …

“কেউ কেউ এমন শেষ দেখেন যেখানে কোনো আশা নেই, আবার কেউ কেউ এমন আশা দেখেন যার কোনো শেষ নেই।” জানি না কথাটা কে বলেছিলেন, তবে ‘হোপলেস এন্ড’ আর ‘এন্ডলেস হোপ’ নিয়ে বিশ্ব বহু আগেই দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে। থাকবে অনন্তকাল। জগতের শত দুর্বিপাক, শত ঝড়ঝাপটার মধ্যেও কেউ কেউ তাই আশায় বসতি করে, আর কেউ কেউ দুর্ভাগ্যকে গালমন্দ করেই সময় কাটায়, সর্ষের মধ্যে দেখে হাজার হাজার ভূত।

গিল স্টার্ন-এর একটা মন্তব্য মনে পড়ছে: “আমাদের সমাজে আশাবাদী আর হতাশাবাদী উভয়েরই অবদান আছে, আশাবাদী বিমান বানায় আর হতাশাবাদী প্যারাশুট বানায়!” স্বীকার করি, চারপাশে অনপনেয় অন্ধকার, দিগন্তব্যাপী দুঃসময় আর বাধার বিন্ধ্যাচল দেখতে দেখতে কেবল আশা নামের হলুদ পাখিটার ভরসায় বেঁচে থাকা বড় কঠিন। তবু এওতো ঠিক, নিয়তির কাছে অসহায় আত্মসমর্পণের প্রবল পরাক্রান্ত মুহূর্তটিতে আশা ছাড়া আর কোনো সঙ্গীর কথা কি ভাবা যায়? নাকি সঙ্গী পাওয়া যায়? তাইতো হতাশায় খিন্ন হতে হতে, দীর্ণ হতে হতে, শেষমেষ আশাকেই ত্রাতা মানতে হয় সবার।এজন্যই বোধহয় পথ হারানো পথিকের মত জীবনের ছায়াপথে আশাকে খুঁজতে খুঁজতেই সময় কাটে আমাদের। কে না খোঁজে আশাকে? ডাক্তার যাকে জবাব দিয়ে দিয়েছেন, ‘অসম্ভব অসুখ’ থেকে যার আর কোনো উদ্ধার নেই, মৃত্যুকে বরণ করাই যার নিয়তি, সামান্য একটু সান্ত্বনার বাণী শুনলে তারওতো চোখদুটো চকচক করে উঠে, চেহারাটা একটু হলেও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আশা! কলকাতার ফুটপাথে হাঁটতে হাঁটতে, নিজের রক্তে অনন্ত বিসারিত ট্রাম লাইনের বিষাক্ত ছোঁয়া অনুভব করতে করতে, নরম বৃষ্টির হিমস্পর্শে কাঁপতে কাঁপতে জীবনানন্দও ভাবছিলেন দূরের সবুজ প্রান্তর, নদী আর জোনাকির কথা। ভাবছিলেন – আকাশের তারাগুলো সব হারিয়ে গেল নাকি? আশা!

জন ক্লেয়ারের কবিতা মনে পড়ে: এমনকি যে ছোট ভায়োলেট ফুল, সেও অপেক্ষায় থাকে আগামী বসন্তে নতুন করে কুঁড়ি ফোটানোর; আর মানুষ – সে নিশ্চয়ই ভায়োলেটের চাইতেও নগণ্য নয়? দ্বিতীয় একটি বসন্ত পাওয়ার অধিকার তো আছে তারও।” আশা! টেরি ফক্সের কথা মনে পড়ে। ক্যান্সারের সংক্রমণে এক পা হারানোর পরও ক্যান্সারের বিরুদ্ধে মানুষকে জাগানোর সংকল্প নিয়ে মাত্র এক পায়ে কানাডার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দৌড়াতে শুরু করেছিলেন ফক্স। সাড়ে তিন হাজার মাইল দৌড়ানোর পর আর পারেননি, আলিঙ্গন করতে বাধ্য হয়েছিলেন মৃত্যুকে। ফক্স জানতেন কী পরিণতি হবে তাঁর, তবু হাল ছাড়েননি। বিশ্বখ্যাত তাঁর সেই দৌড়ের নাম দিয়েছিলেন ‘ম্যারাথন অব হোপ’। আশা!

১৯৬৩-র ২৮ আগস্ট ওয়াশিংটন ডিসি-র লিংকন মেমোরিয়ালের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দুই লক্ষ মানুষের উদ্দেশে ইতিহাসখ্যাত সেই ‘আমার একটি স্বপ্ন আছে’ বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন বর্ণবৈষম্য মুক্তি আন্দোলনের মহানায়ক মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র। আর কি সেই বক্তৃতা, এককটি শব্দ তো নয়, যেন একেকটি কবিতা, একেকটি নীল অপরাজিতা। ‘আমার একটি স্বপ্ন আছে। আমার ছোট ছোট চারটি ছেলেমেয়ে একদিন এমন এক দেশে বাস করবে যেখানে গায়ের চামড়ার রঙ দিয়ে নয়, চরিত্রের শক্তি দিয়ে বিচার করা হবে তাদের।’ অথবা ‘আমার একটি স্বপ্ন আছে। একদিন জর্জিয়ার লাল পাহাড় থেকে নেমে এসে সাবেক দাস আর দাসমালিকদের সন্তানরা একই টেবিল ঘিরে একসঙ্গে বসবে যে টেবিলের নাম ভ্রাতৃত্ব।’ অথবা ‘এই আমাদের আশা। এ বিশ্বাস নিয়েই হতাশার পর্বত থেকে আশার পাথরখণ্ড বের করে আনব আমরা। এ বিশ্বাস নিয়েই কোলাহলে পূর্ণ আমাদের এ জাতির মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সুরলহরী তৈরি করব। এ বিশ্বাস নিয়েই আবার একসঙ্গে কাজ করব, একসঙ্গে প্রার্থনা করব, একসঙ্গে যুদ্ধ করব, একসঙ্গে জেলে যাব, একসঙ্গে স্বাধীনতার জন্য বুক চিতিয়ে দাঁড়াব, কারণ আমরা জানি একদিন মুক্ত আমরা হবই।’ মার্টিন লুথার কিং আশা ছাড়েননি বলেই একদিন বারাক ওবামা নামের কৃষ্ণসন্তান যুক্তরাষ্ট্রের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হতে পেরেছেন। আপনাদের কি রোসা পার্কসকে মনে আছে? ১৯৫৫-এর একদিন। আলাবামা-র মন্টগোমারি শহরের একটি বাসে করে যাচ্ছিলেন পার্কস। এমন সময় একজন যাত্রী উঠলেন যার গাত্রবর্ণ সাদা, ড্রাইভার কৃষ্ণাঙ্গিনী পার্কসকে নির্দেশ দিল সিট ছেড়ে সাদা মানুষকে বসতে দেয়ার জন্য। এর আগে কোনো কৃষ্ণাঙ্গ যে সাহস দেখায়নি সে সাহসই দেখালেন পার্কস। সোজা বলে দিলেন: আমি উঠবো না। সেদিন থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার আন্দোলন গতি পেল। মার্টিন লুথার কিং আবির্ভুত হলেন কৃষ্ণাঙ্গদের সম অধিকারের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে। লক্ষ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটলেন ওয়াশিংটন ডিসির রাজপথে। মানুষের মুক্তির দাবিতে। ২০০৯ সালে ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবার পর সেদেশের কালো মানুষদের মোবাইল ফোনে একটা মেসেজ দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়েছিল, মেসেজটি ছিল এরকম: ”Rosa sat so that Martin could walk. Martin walked so that Barack could run. Barack ran so that our children could fly”। রোসা বসেছিল যাতে মার্টিন হাঁটতে পারে, মার্টিন হেঁটেছিল যাতে বারাক দৌড়াতে পারে, আর বারাক দৌড়েছিল যাতে আমাদের সন্তানরা উড়তে পারে। উড়বে, সাদা মানুষ কালো মানুষ নির্বিশেষে আমাদের সবার সন্তানই একদিন মুক্তির আকাশে উড়বে, কারণ শেষ বিচারে তারা যে সব অমৃতের সন্তান! কথায় আছে, মানুষ তার আশার সমান বড়। লিওনার্ড লুই লেভিনসন বলেছিলেন, ‘হতাশাবাদী কেবল মেঘের কালো অংশটাই দেখে আর হতাশায় মাথা নাড়ে, দার্শনিক উভয় অংশই দেখেন আর উদাসভাবে কাঁধ ঝাকান, আর আশাবাদী কোনো মেঘই দেখেন না, কারণ তিনিতো মেঘের ওপর দিয়ে হাঁটছেন!’

চারপাশে তাই যখন তুমুল তমিস্রা ঘিরে ধরছে আমাদের, মনে হচ্ছে অনন্ত অন্ধকারের কবল থেকে বাঁচার উপায় নেই কারও, তখনও পৃথিবীর শেষ আশাবাদী মানুষদের মত আশাকেই ভরসা করতে ইচ্ছে করে। অস্কার ওয়াইল্ড-এর বরাভয় কানে আসে: ‘আমরা সবাই পড়ে আছি নর্দমায়, তবু আমাদেরই মধ্যে কারো কারো চোখ নক্ষত্রের দিকে!’

আসুন কণ্টকমুকুট মাথায় দিয়েও আমরা সবাই নির্নিমেষ নক্ষত্রের দিকেই তাকাই। আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে সব দুঃখকে হেলায় জয় করি!

This entry was posted in মুক্তগদ্য. Bookmark the permalink.

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s