আমার আত্মজীবনী পাঠ- তৃতীয় পর্ব

এক.

মৃত্যুর পর তোমরা আমাকে কংশের জলে ভাসিয়ে দিও।
যদি শিমুলের তুলা হতাম, বাতাসে উড়িয়ে দিতে বলতাম,
কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, আমি বাতাসের চেয়ে হালকা নই।
আমাকে তোমরা কাঠের আগুনে পুড়িয়ে ফেলো না,
কিংবা মাটি খুঁড়ে কবর দিও না আজিমপুর বা বনানীতে।
বর্জ্যপদার্থের মতো আমি চাই না মাটিতে মিশে যেতে।
মৃত্যুর পর তোমরা আমাকে কংশের জলে ভাসিয়ে দিও।
যাতে জলপথে ভাসতে-ভাসতে, ভাসতে-ভাসতে
আমি পৌঁছুতে পারি পৃথিবীর নব-নব দেশে।

না। তাঁর মৃত্যু ঘটেনি। তেমন দূর্ঘটনা যেন না ঘটে। শতায়ু হন কবি, কবি নির্মলেন্দু গুণ। তবে তাঁর বাসনা টিকে বড়োই করুণ আর মনোরম লাগে, তাই কবিতাংশটি উঠিয়ে দেয়া।

নেত্রকোনা জেলার (তৎকালীন মহকুমা) কংসের তীরের কবি নির্মলেন্দু গুণ। তাঁর জীবনী গ্রন্থ-“আমার কণ্ঠস্বর” এবারের গ্রন্থালোচনার বিষয়। আপনারা বলতে পারেন, কতো- কতো জীবনী গ্রন্থইতো রয়েছে। তবে কেনো এটি? আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই প্রথম আলোচনাটির কথা, সেখানে হুমায়ুন আজাদ বাংলা ভাষায় লিখিত আত্মজীবনী গ্রন্থগুলোর ব্যাপারে তাঁর হতাশা ব্যক্ত করে সেগুলোকে মোটামুটি উড়িয়ে দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছিলাম (একটি প্রবন্ধের সূত্র ধরে)। আজকে আমি একজন বাঙালির আত্মজীবনীকেই আলোচনায় নিয়ে এসেছি, সফল অর্থে, (ভবিষ্যতে আরো কয়েকজনের আসবে)। আফসোস, জানা হবে না এই গ্রন্থটি নিয়ে হুমায়ুন আজাদের অনুভূতির কথা।

বইটিতে নির্মলেন্দু গুণের পূর্ণাঙ্গ জীবন কাহিনি নেই। জীবন নামের গাড়িটির গল্প বলতে গিয়ে কবি ১৯৭০ পর্যন্ত গিয়ে থামিয়ে দিয়েছেন গ্রন্থের চাকা, যখন কেবলমাত্র তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ-প্রেমাংশুর রক্ত চাই প্রকাশিত হয়েছে।

নির্মলেন্দু গুণ বাংলা ভাষার একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি। তিনি জাত কবি, এবং কবিতার জন্য জীবনৎসর্গ করার মতো সাহসী কবিদের মধ্যে অন্যতম একজন। ছোটবেলা থেকে ছিলেন দূরন্ত, কিন্তু মেধাবী। মেধার স্বাক্ষর রেখে মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক, তারপর সেই যে ভবঘুরে হলেন, বাকী জীবনটা তাঁর আর থিতু হয়নি।

তাঁর দূরন্তপনা শুরু হয় মূলত ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে উচ্চমাধ্যমিক ক্লাসে ভর্তি হবার পর থেকে। লেখাপড়ার চেয়ে জুয়া খেলার দিকেই তাঁর নজর ছিল বেশি। একবার কলেজের হিন্দু হোস্টেলের ম্যানেজার নির্বাচিত হলেন। শুরু হলো বাজারের টাকা মেরে দেবার কাজ। সেই টাকা দিয়ে বহু শখের টেডি জুতো কেনা হলো, আরো কেনা হলো আকাশী নীল কেরলিন শার্টও। কথা আছে পাপ নাকি বাপকেও ছাড়ে না। জুয়ার আড্ডায় ধরা পড়লেন নির্মলেন্দু গুণ, সঙ্গে সঙ্গে পত্রপাঠ বিদায়। সাঙ্গ হলো তাঁর আনন্দমোহনের আনন্দময় রাত-দিনের আড্ডা। ফিরে এলেন নেত্রকোনায়, ভর্তি হলেন নেত্রকোনা কলেজে।

এরপরের ইতিহাস বড়োই বেদনাদায়ক। কবি মেধাতালিকায় স্থান পেয়েও ইঞ্জিনিয়ারিং-এ চান্স পেলেন না। কারণটা মর্মান্তিক। ১৯৬৫ সালের সাথে আজকের বাংলাদেশের তফাৎ কতোটা সেটি গুণীরা বলতে পারবেন, আমি শুধু কবির কথাতেই বাক্যটি হজম করি-

ভারত এনিমি স্টেট বলে বিবেচিত। পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুরাও কিয়দংশে এনিমিটিরি দায়ভাগ বহন করে।

ঢেউ গড়াতে গড়াতে কোথায় কোথায় চলে যায়…। খুব অবস্থাপন্ন ঘরের সন্তান ছিলেন না। তাঁর পিতার কোলকাতার আর্ট কলেজে পড়ার সুযোগ হয়েও, ললাটে সেই লেখাপড়া নিস্পত্তির ভাগ্য জোটেনি। তেমনি ভালো ফলাফল করেও কবির ঠাঁই হলো না কোথাও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি বিভাগে ভর্তির জন্য মনোনিত হয়েও দূভার্গের কারণে চূড়ান্ত ভর্তির ভাগ্য হয়নি। অবশেষে, আবার সেই আনন্দমোহন ! ডিগ্রী ক্লাসে সেখানেই ফিরে যান কবি। আর সেই ফিরে আসা আসলে কার কাছে ফিরে আসা হলো সেটি কবি যেভাবে বিবৃতি করলেন, সেটি পড়ে ভাষার মুন্সিয়ানায় মুগ্ধ হওয়া যায় বটে, কিন্তু সমস্ত যুক্তির জাল ফেলেও সেটিকে গ্রহণ করা যায় না।
অবশ্য, আমি আপনি এসব গ্রহণ করার কে? এ তো যার তার জীবন কাহিনি নয়। এটি একজন কবির জীবন কাহিনি। কবি তাঁর অসামান্য গদ্যে লেখেন-

আমি আমার আনন্দ সন্ধানী ইন্দ্রিয়কে দমন করার পরিবর্তে, জগতের আনন্দযজ্ঞের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করি। আমি নবজাগ্রত যৌবনের ডাকে সাড়া দিই – খরতপ্ত গ্রীষ্মের প্রথম বর্ষণের ডাকে ডিমওয়ালা কৈ মাছ যেরকম সাড়া দেয়। আমি সাড়া দিই – উষ্ণ গাভীর ডাকে বির্যবান ষাঁড় যেরকম সাড়া দেয়। আমি সাড়া দিই – মিষ্টদ্রব্যের গন্ধে পিঁপড়ের দল যেরকম সাড়া দেয়। আমি সাড়া দিই – টারজানের ডাকে অরণ্যের হিংস্রপশুরা যেরকম সাড়া দেয়।

এতসব আনন্দযাপন, সঙ্গে সঙ্গে চলছে কবিতা লেখার কাজ। লিখতেন ইংরেজি কবিতা, তবে, পরে সেটি নিয়মিত ছিল না। বাংলা কবিতা ছাপা হতে লাগলো বিভিন্ন পত্রিকায়। কিন্তু কবি তো জীবন বিলিয়েছেন হেলাফেলায় কাছে, সেটির গন্তব্য কোথায় তা শুনতে গিয়ে জগতের সমস্ত সুশীল মুখ স্তব্ধ হয়ে যাবে। কবি বলেন-

মদ্য-পদ্য-সিদ্ধি-গণিকা-জুয়া,- এই পঞ্চভুতের পাদপদ্মে আমি উৎসর্গ করি আমাকে।

দুই.

আনন্দমোহনের আনন্দে আকণ্ঠ নিমজ্জিত কবির জীবনে হঠাৎ করেই এক অদ্ভুত সমস্যা উপস্থিত হয়। নেত্রকোনার বারহাট্টার এক ডাকাত পুলিশের হাতে ধরা খেয়ে সহযোগী হিসেবে যাদের নাম জমা দেন তাদের মধ্যে জ্বলজ্বল করা একটি নাম-নির্মলেন্দু প্রকাশ গুণ চৌধুরী (এই নামটি কাটছাঁট করেই আজকের নির্মলেন্দু গুণ)। জীবন নিয়ে খেলায় নামা কবি শেষ পর্যন্ত ডাকাত দলের সদস্য বনে যাবেন তা নিশ্চয়ই কল্পনায়ও ভাবেন নি। কিন্তু সেটিই ঘটলো। ফেরারী হলেন কবি। আর এই ফেরারী পথই তাঁকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে এলো নতুন ঠিকানায়। আশ্রয় দিলো ঢাকার বুকে।

তিন.

এরপর শুরু হলো ঢাকার জীবন। কেমন ছিল সেই জীবন? লিখতে গেলে মহাকাব্য হয়ে যাবে। ঢাকায় এসেই পুরনো বন্ধু মামুনুর রশীদ (প্রখ্যাত অভিনেতা)-এর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এর ডেরায় উঠেন কবি। মামুনুর রশীদই পরিচয় করিয়ে দেন-কণ্ঠস্বর সম্পাদক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর সঙ্গে। একটি কাজ কবির খুবই দরকার ছিল। সায়ীদ স্যার তাঁকে দায়িত্ব দেন কণ্ঠস্বর এর বিজ্ঞাপন যোগাড়ের কাজে। সায়ীদ স্যারের সাইকেল নিয়ে টইটই করে শহর ঘুরে কবি লেগে যান তাঁর কাজে।

চার.

জীবনের বাঁকগুলো নির্মলেন্দু গুণের ছিল খুবই রোমহর্ষক। কণ্ঠস্বর নিয়ে তাঁর আবেগ যখন তুঙ্গে, তখন আবদুল মান্নান সৈয়দ-এর লেখা বেশি পরিমানে ছাপানোর ইস্যুকে সামনে নিয়ে তিনি কণ্ঠস্বর ত্যাগ করেন। কিন্তু পুরো গ্রন্থে কণ্ঠস্বর-এর প্রতি তাঁর প্রেম আর ভালোবাসা ছিল উল্লেখ করার মতো। বন্ধুদের প্রতি অকৃত্রিম আর সৎ নির্মলেন্দু গুণ বন্ধু গীত গেয়েছেন পুরো বইতেই। তেমন একজন-“চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা” কবি-আবুল হাসান।

আবুল হাসান সহ কী করেন নি নির্মলেন্দু গুণ ! ফুটপাত-মসজিদ-রেল স্টেশন মায় বেশ্যালয় সব জায়গাকেই শয্যার আশ্রয় করেছিলেন। দুজনে ছিলেন কবিতার কর্মী। সারারাত ধরে যত্রতত্র জুয়া খেলা আর কবিতা লেখা, এই ছিল রুটিন কাজ। তবে, আবুল হাসান তেমন একটা জুয়া খেলতেন না। আবার আবুল হাসান না থাকলে নির্মলেন্দু গুণের জীবন যে শুধু জুযা খেলেই কাটতো; কবিতা লেখা আর হতো না, সেটিও কবি উল্লেখ করেছেন। টাকার টানাটানি ছিল নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। টাকার অভাবে তিনবেলা ভাত জুটতোনা। কার প্লেটে ভাত খাচ্ছেন, কার টুথব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজছেন, কোনো খেয়াল নেই। কিন্তু, কবিতার লাইন এলোমেলো হলো কি না, সেটি কিন্তু খুব খেয়ালে থাকতো। এমনই জাত কবি-নির্মলেন্দু গুণ। বিছানা-বালিশ থাকা , না-থাকা নিয়ে কবির অনুভূতি পড়ুন-

বিছানা-বালিশ, গামছা-মশারি, থালা-বাসন এগুলো যে নিজের থাকতে হয়- তা আমি জানতাম, কিন্তু থাকার নির্দিষ্ট জায়গা ও টাকার অভাবে ওগুলো সংগ্রহ করা হয়ে ওঠেনি। আর এগুলো যে আমার নেই তা বুঝতেও আমার বেশ সময় লেগেছিল।

পাঁচ.

প্রেম তাঁর জীবনে এসেছে ভীরু পায়ে। বিশিষ্ট লেখিকা পূরবী বসুকে ভালোবেসেছিলেন। কিন্তু অস্থির আবেগের কথা তাঁকে জানাবার আগেই মাথায় আকাশ ভেঙে খবর আসে সেই নারী আরেকজনের বাগদত্তা। তারপর আবার ভেসে যাওয়া। তারপর আবার গণিকালয়ে যাত্রা। কবি তাঁর স্বভাবগত ভাষায় ঢাকায় আগমণের পরের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেন,

ঢাকায় আসার সময় আমার বাম হাতে ছিল বাবার কিনে দেওয়া একটা ক্যাভেরলি ঘড়ি আর ডান হাতের অনামিকায় ছিল ঝিলমিল-পাথর বসানো একটি চার আনা স্বর্ণের আঙটি। এই নগরী প্রথম সুযোগেই ও দুটো আমার হাত থেকে পর্যায়ক্রমে খুলে নেয়। বাবার ঘড়িটি যায় জুয়ার আড্ডায়, আর নাম- ভুলে যাওয়া সুদর্শন পাথর বসানো আমার ঐ সুবর্ণ-অঙ্গুরীয়টি গ্রাস করে পুরনো-ঢাকার অবলা মাসির মেয়েরা। এর পর যথার্থ অর্থেই আমি ছিলাম একেবারে ঝাড়া হাত-পা। কবিতার পান্ডুলিপি ছাড়া আগলে রাখার মতো আর কিছুই ছিল না।

ছয়.

গ্রন্থে যেভাবে কবি নির্মলেন্দু গুণ জীবনকে দেখিয়েছেন, সেসব দেখে মনে হলো- জীবন নিয়ে যেন একধরনের রসিকতাই করে গেলেন কবি। আমাদের যেসব কবি, লেখকরা প্রতিষ্ঠা আর সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠাকে জীবনের প্রধান কর্ম ধরে নিয়ে তারপর সাহিত্য রচনা করছেন, তাদের কাছে এ-এক স্পর্ধিত বিস্ময় হয়ে থাকবে; যখন দেখা যায়, তুড়ি মেরেই কবি কাটিয়ে দিলেন একটা জীবন।

হুলিয়া কবিতাটি লিখে প্রসিদ্ধ হওয়া কবি নির্মলেন্দু গুণ এর এমনতর জীবন কাটানো নিয়ে আলোচনা হতে পারে, চায়ের টেবিলে ঝড় উঠতে পারে অনেক, কিন্তু প্রকৃত অর্থেই সাহসী কলমে ধুলোর মাঝে গড়াড়ড়ি দিয়েও জীবনের যে জয়গান কবি নির্মলেন্দু গুণ আলোচ্য গ্রন্থে করলেন, তা সবাই পারে না। আমরা ইতিমধ্যে কারো কারো আত্মজীবনীর নামে অক্ষম প্রচেষ্টা দেখেছি, কিন্তু সত্য উচ্চারণ উল্লেখযোগ্যভাবে কবি নির্মলেন্দু গুণই করলেন। তাই, কবি নির্মলেন্দু গুণ, আপনি জানেন কি না জানি না, এখানে কিন্তু সবাইকে হারিয়ে দিলেন আপনি।

This entry was posted in রিভিউ. Bookmark the permalink.

4 Responses to আমার আত্মজীবনী পাঠ- তৃতীয় পর্ব

  1. aliarafatshanto বলেছেন:

    পাওয়া গেলো অবশেষে!

  2. Nirmalendu Goon বলেছেন:

    ধন্যবাদ লীনা দিলরুবা। আপনি যে বিশেষ গুরুত্ব দিযে আমার বইটি পাঠ করেছেন,, সেজন্য আমি অন্তরে বড় আনন্দ পেলাম। আমি আমার জীবনকে যতটা না নির্মাণ করার চেষ্টা করেছি,, তার চেয়ে আমার জীবন নামক প্রবাহটিকে গোয়েন্দার মতো অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি। মহাজীবনের কাব্য নামে এবারের বইমেলায় আমার আত্মজীবনীর একটি ৭০০ পৃষ্ঠার অখণ্ড সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে-যার ভিতরে রয়েছে আমার ছেলেবেলা, আমার কণ্ঠস্বর, আত্মকথা ১৯৭১ এবং রক্তঝরা নভেম্বর ১৯৭৫। আমার জীবনের তিরিশ বছর সময়কাল ( ১৯৪৫-১৯৭৫)বিবৃত হয়েছে সেই বইতে। বইটি আপনাকে উপহার হিসেবে দিত চাই। আপনার ঠিকানা দিলে বইটি কুরিয়ারে আপনাকে পাঠাতে পারি। আমার মুঠোফোন : ০১৭১৭১১৬৬১৩। ইচ্ছে হলে যোগাযোগ করতে পারেন। ভালো খাকুন।
    ,

    • leenadilruba বলেছেন:

      আপনার মন্তব্য পেয়ে সত্যিই আপ্লুত হলাম। কি যে বলবো বুঝতে পারছিনা। আপনার বইটি আমি সংগ্রহ করবো। আপনার সাথে যোগাযোগ করবো অবশ্যই্।

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়েছে।