বিখ্যাত ইংরেজ কবি-সমালোচক-নাট্যকার ড্রাইডেন বায়োগ্রাফি বা জীবনীর স্বরূপ চিহ্নিত করতে গিয়ে একে “বিশেষ মানুষের জীবনের ইতিহাস” বলে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন। বোধ করি এটিই বায়োগ্রাফির গ্রহনযোগ্য সংজ্ঞা। “বিশেষ মানুষের” জীবনের ইতিহাস হিসেবে যখন আত্মজীবনী গ্রন্থটি বাক্যবন্দি হয়, তখন কে’ বা কার দ্বারা এ-ধরনের গ্রন্থ লিখিত হবে সেটি নির্দিষ্ট হয়ে যায়। ইংরেজি ভাষায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী রচিত হয় চতুর্থ খ্রিষ্টাব্ধে। সেন্ট অগাস্টিনের-“কনফেশন্স।”
ছোটবেলা থেকে বিখ্যাত মানুষদের জীবনীগ্রন্থ সংগ্রহ করা এবং পড়া আমার অন্যতম পছন্দের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহুবছর ধরে আমি আত্মজীবনী গ্রন্থ সংগ্রহ করছি, পড়ছি। আত্মজীবনী প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে হুমায়ুন আজাদ তাঁর একটি প্রবন্ধে বলেছিলেন, “আত্মজীবনী এক ধরনের উপন্যাস, এক ধরনের রিমেমব্রান্স অফ থিংজ পাস্ট” (সীমাবদ্ধতার সূত্র, পৃ ৬২)। কথাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এই অর্থে যে- তিনি আত্মজীবনীকে আত্মজৈবনিক উপন্যাস হিসেবে মূল্যায়ন করেছিলেন। একটি আত্মজীবনী যদি সুলিখিত এবং গ্রহনযোগ্য হয়, তবে এটি সফল একটি উপন্যাসের জায়গা দখল করতে পারে তা বলাই বাহুল্য। অবশ্য প্রবন্ধটিতে তিনি বাংলা ভাষায় লিখিত আত্মজীবনীগুলোর ব্যাপারে তাঁর হতাশা ব্যক্ত করে ওগুলোকে মোটামুটি উড়িয়ে দিয়েছিলেন। হুমায়ুন আজাদ উড়িয়ে দেবার মত ক্ষমতাশালী লেখক। আমি সাধারণ পাঠক। বাংলায়ও যে সফল আত্মজীবনী লিখিত হতে পারে সেটি বেশ কয়েকজন বাঙালি রীতিমত দেখিয়ে দিয়েছেন। সেসব আত্মজীবনী নিয়ে এবং আমার পড়া শ্রেষ্ঠ আত্মজীবনীগ্রন্থগুলো নিয়ে একটি সিরিজ করার ইচ্ছে থেকেই এ-লেখা শুরু করা।
ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজে কেন আত্মজীবনী পড়ি এই প্রশ্নটি নিজেকে করে যে উত্তরটি পেয়েছি তা হল- একজন মানুষ যখন সফল হন তার সাফল্যের পেছনে অবশ্যই অনেক ইতিহাস থাকে। অনেক সংগ্রাম থাকে, ত্যাগ থাকে, নিষ্ঠা থাকে, পরিশ্রম থাকে। কেউ তো রাতারাতি খ্যাতিমান বা সফল হয়ে যান না। এই খ্যাতি বা সাফল্য একজন মানুষের জীবনে কীভাবে আসে সে-সব জানতে আমি আত্মজীবনী পড়ি। কেউ কেউ বলেন, আত্মজীবনীতে মানুষ নিজেকে মহান করে দেখায়, মিথ্যে কথায় ভরা থাকে আত্মজীবনী। কথাটিকে যদি মেনেও নিই, তবু এ-কথাটি বলা যায়, কেউ নিজে কিছু বানিয়ে লিখলে সেটি সত্যি হয়ে যায় না। তথ্যজানার সুবিধে আর সহজে যোগাযোগ স্থাপনের এই সময়ে বিখ্যাত ব্যক্তিদের কোনো কিছু অজানা থাকে না। তাই, বিখ্যাত ব্যক্তিদের লেখা পড়ে এবং তাঁর সম্পর্কে অন্যদের মূল্যায়ণ পড়ে একটি ধারনা যদি নেয়া যায় তবে সেটি ভাল বই খারাপ হবার নয়, এবং একটি প্রায় পূর্নাঙ্গ ধারনা এভাবে নেয়া সম্ভব।
হুমায়ুন আজাদের প্রবন্ধটিতে বাট্রার্ন্ড রাসেল এবং পাবলো নেরুদার আত্মজীবনী গ্রন্থের কথা বলা হয়েছে- সফল অর্থে। দুটো গ্রন্থই পাঠের সুযোগ আমার হয়েছে। এ-পর্বে রাসেল-এর আত্মজীবনীগ্রন্থের কথা বলা যাক।
রাসেল-এর আত্মজীবনী-“দ্য অটোবায়োগ্রাফি অব বাট্রার্ন্ড রাসেল”কে পৃথিবীর ইতিহাসে এ-পর্যন্ত লিখিত আত্মজীবনীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ আত্মজীবনী বলা হয়ে থাকে। বিখ্যাত এই মনীষীর তিনখন্ডের আত্মজীবনীটিতে শুধু একজন ব্যক্তির জীবনের খুঁটিনাটি লেখা নেই, লেখা আছে একটি কালের ইতিহাস। ১৮৭২ সালে জন্ম নেয়া রাসেল মৃত্যুবরণ করেন ১৯৭০ সালে। বিয়ে করেছিলেন চারটি। ১৯৫০ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন তিনি।
তাঁর প্রকৃত নাম বার্ট্রান্ড আর্থার উইলিয়াম রাসেল। তাঁর পিতামহ লর্ড জন রাসেল দুইবার ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হন। বয়স পাঁচ-এ না যেতেই রাসেল তাঁর মা-বাবা দুজনকেই হারান। বিবাহিত জীবন ছিল ঘটনাবহুল। ১৮৯৪ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে বিয়ে করেন এ্যালিস পিয়ারসলকে। ১৭ বছর পর বিচ্ছেদ ঘটে সেই বিয়ের। দ্বিতীয় স্ত্রী ডোরা উইনফ্রেড ব্ল্যাক। এটিও টেকেনি। বিয়ের ১৪ বছর পর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় দুজনার। ১৯৩৫ সালে বিয়ে করেন প্যাট্রিসিয়া স্পেন্সকে। এটিই শেষ নয়। চতুর্থ বারের মত বিয়ের টোপর পরেন ৮০ বছর বয়সে। বিয়ে করেন এডিথ ফিন্সকে। এ বিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত, মানে ৯৮ বছর বয়স পর্যন্ত টেকে।
জীবনের আলোকিত দিকটি শুধু নয়, নিজের জীবনের অন্ধকার দিকের কথাও রাসেল তাঁর আত্মজীবনী গ্রন্থে লিখে রেখে গেছেন। বয়ঃসন্ধিতে শারীরিক পরিবর্তনের যে অভিজ্ঞতা সেটি তাঁর মনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। স্বমেহনের অভ্যেস বিশ বছর পর্যন্ত বজায় রেখে তিনি মনে মনে পুড়তেন। এটি বন্ধ করার অভিপ্রায়ের কথাও বলেন। যখন প্রেমে পড়েন তখন এটি বন্ধ হয়ে যায়। নারী শরীরের প্রতি অতি আগ্রহ নিবারণে নানা কায়দাকানুনের আশ্রয় নিতেন। একসময় এসব নিয়ে দহনে পুড়লেও গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান অর্জন মনে করে একে মানসিক ব্যাধিগ্রস্থতা বলে মনে করতেন না। নারী শরীরের প্রতি মোহমুগ্ধতার কারণেই একসময় কবিতার প্রেমে পড়ে যান। ষোল-সতের বছর বয়সেই মিলটন, বায়রণ, শেলীর কবিতা পড়ে শেষ করেছিলেন।
ছোটবেলা থেকেই গণিতের প্রতি মোহগ্রস্থতা ছিল। প্রচন্ড ভাবুক ছিলেন। ষোল বছর বয়সের একটি অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বলেন, একাকী ঘুরে বেড়ানোর প্রতি আকর্ষণ ছিল। সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে তাঁর যখন-তখন আত্মহত্যা করার ইচ্ছে জাগতো। তিনি আত্মহত্যা করেন নি, কারণ, গণিত সম্পর্কে তাঁর জানার আকাঙ্ক্ষা অটুট ছিল।
জীবনীগ্রন্থের শেষ প্যারায় নিজের জীবনের ব্যর্থতাগুলোকেও তাঁর নিজের অর্জন বলেই মনে হয়েছে, তিনি বলেন, আমি আসলে এসব সত্ত্বেও বিজয়ী হয়েছি। তাত্ত্বিক সত্যকে কখনো কখনো অস্বীকার করলেও অন্য এক ধরনের সত্যকে তিনি নিজের জীবনের পাথেয় করে নিয়েছিলেন। জীবনযাপনে ব্যক্তিগত লক্ষ্য এবং সামাজিক লক্ষ্য দুই-এর মাঝে আনুপাতিক সমঝোতা স্থাপনের মাধ্যমে একটি সফল জীবন কাটানোর জন্য তাঁর তৃপ্তিবোধের কথা তিনি উল্লেখ করেন। ১৯৬৯ সালে লেখা তাঁর আত্মজীবনী গ্রন্থের শেষপ্রান্তে তিনি সেই সময়ের সমাজকে বিপজ্জনক বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন, নতুন নতুন চিন্তা, আশা, নতুন ধরনের স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতা থাকলেও তার ওপর নতুন ধরনের নিয়ন্ত্রন আরোপ করা খুবই প্রয়োজন।
পুরো আত্মজীবনী গ্রন্থে অসংখ্য পত্রাবলী জুড়ে দেয়া হয়েছে। এসব চিঠি পড়ে রাসেলকে গভীরভাবে জানার সুযোগ ঘটে। একজন গণিতশাস্ত্র বিশারদ, একজন দার্শনিক হিসেবে খ্যাত হলেও তিনি ছিলেন একজন নীতিনিষ্ঠ মানবাতাবাদী। আজকের পৃথিবীতে স্বল্পজ্ঞানকে পুঁজি করে বিখ্যাত হবার যে প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায়, সেদিক বিবেচনায় নিলে রাসেল ছিলেন একজন আশ্চর্য ব্যতিক্রম। তিনি বিখ্যাত সব গ্রন্থেরও রচয়িতা। “প্রিন্সিপালস অব ম্যাথম্যাটিকস”, ”হিস্টোরি অব ওয়েস্ট্রার্ণ ফিলোসফি” “দ্য কনকোয়েস্ট অব হেপিনেস”, “ম্যারিজ এন্ড মরালস”, “হোয়াই আই এ্যাম নট এন ক্রিশ্চিয়ান” ইত্যাদি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
“ম্যারিজ এন্ড মরালস” বইটি পাঠের সুযোগ আমার হয়েছে। এত আধুনিক চিন্তাধারা ছিল তাঁর, বইটি পড়তে গিয়ে প্রথাগত জীবনের নানা আচারের অর্থহীনতায় মানুষ বারবার ভাবতে বসবে। বইটি সম্পর্কে কিছু ধারনা দেয়া যাক।
রাসেল বলেছেন, একালের নৈতিকতার উৎস দুটি; পিতৃত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হবার আকাঙ্ক্ষা এবং যৌনতা সম্পর্কে খারাপ ধারনা। রাসেল অবাধ যৌনতাকে খারাপ বলে চিহ্নিত করেন নি। কিন্তু একইসাথে তিনি আত্মসংযমের কথাও বলেছেন। এক্ষেত্রে আবার সংযমের সঙ্গে যেন ব্যক্তি স্বাধীনতার বিরোধ না ঘটে সেটাও তিনি নিশ্চিত হতে বলেছেন। বিবাহের মূল লক্ষ্য সন্তান পালন- এটা রাসেলের মতামত। সন্তান পালনের ব্যাপারটা না থাকলে তিনি বিবাহের পুরোই বিরোধী হতেন বলে জানিয়েছেন।
পৃথিবীজুড়ে আদি থেকে গঠিত বৈবাহিক সম্পর্ক, পারিবারিক সম্পর্ক, ক্ষমতা, প্রেম, নৈতিকতা নিয়ে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ প্রদান করেছেন বার্টান্ড্র রাসেল। যিনি একাধারে দার্শনিক, গণিতজ্ঞ, বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিজ্ঞ, নীতিবিশারদ এবং ইংরেজি সাহিত্যের একজন শ্রেষ্ঠ গদ্য লেখক ছিলেন।
বইটি কয়েকটি অধ্যায়ে রচিত। সেসব থেকে আমরা যদি মূল বিষয়গুলোকে বের করে আনতে চাই তাহলে যে পয়েন্টগুলো আসতে পারে তা একে একে তুলে দিলামঃ
১) মাতৃতান্ত্রিক সমাজ আর পিতৃতান্ত্রিক সমাজের চিত্র দেখাতে গিয়ে তিনি পিতৃতান্ত্রিক সমাজকে সব সমস্যার মূল রূপে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেন, ঈর্ষা ব্যাপারটা যে পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে অত্যন্ত প্রবল তার কারণ এই ভীতি যে, উত্তরপুরুষ যদি তার ঔরসজাত না হয়। পিতৃতান্ত্রিক পরিবার সূচিত হবার পর থেকে পুরুষরা নারীর কৌমার্য অটুট রাখা নিয়ে মনোযোগী হন। বিবাহের বাইরে যৌনসঙ্গম অন্যায় বলে পরিগণিত হবার পর পরপুরুষের সঙ্গে সহবাসকে সহজভাবে দেখানোর অবসান হয় বলে তিনি জানান। আজকের দিনেও চীনে পুত্রবধুরা শাশুড়ির অত্যাচারে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন পিতৃতান্ত্রিক পরিবার প্রথার কারণেই। ফ্রান্সে পাত্র ক্রয় করার নিয়ম আছে। রোমান ক্যাথলিকরা বিবাহ বিচ্ছেদ একেবারে অনুমোদন করে না। প্রাচীন চীনে আইন ছিল স্ত্রী বাচাল প্রকৃতির হলে স্বামী তাকে তালাক দেবার অধিকার পাবে।
২) মাতৃতান্ত্রিক সমাজ তাঁর পছন্দের। রাসেল বলেছেন, ট্রবিয়ান্ড দ্বীপের লোকেরা পিতা নামক কোনো বস্তুর অস্তিত্ব জানতো না। এক্ষেত্রে তিনি ম্যালিনাউস্কির রেফারেন্স দিয়ে চমৎকার একটি তথ্য দিয়েছেন। সে দ্বীপের কোনো লোকের স্ত্রী যদি অন্য কারো সন্তান গর্ভে নেন তবে সে লোক তাতে কিছুই মনে করে না, বরং খুশী হত। সতীত্ব শব্দটা তারা জানেই না।
৩) সংসারে সন্তান আসার পর স্বামী-স্ত্রীর সুসম্পর্ক রাখা জরুরী বলে তিনি মনে করেন। এজন্য আত্মসংযম দরকার হলে সেটা মেনে নিতে তিনি পরামর্শ দেন। শুধু অবিশ্বস্ততা নয় হিংসা, ক্রোধ, বদমেজাজকে সন্তানের জন্য বিসর্জন দিতে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন। পিতা-মাতার মধ্যে কলহ হলে সন্তানের স্নায়ুর ওপর চাপ পড়ে। পিতা-মাতার ঝগড়ার ঘটনা সন্তানদের কাছে গোপন রাখতে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন। এ-জন্য বিবাহ টেনে না নিয়ে বিচ্ছেদের পরামর্শ দেয়া হয়েছে।